ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা ;###;রাজনৈতিক নেতারা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারলে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের আঘাত বাঙালীর জীবনে আসত না ;###;বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ছিল ;###;জিয়া ও এরশাদ ছিলেন অবৈধ ক্ষমতা দখলকা

সোনার বাংলা গড়ব ॥ জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ১০:২২, ১৭ আগস্ট ২০১৯

সোনার বাংলা গড়ব ॥ জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলে তার রক্তের ঋণ শোধ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেছেন, এদেশের মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও উন্নত জীবন দিতে বঙ্গবন্ধু আজীবন কষ্ট করে গেছেন। দেশের মানুষের জন্য নিজের বুকের রক্ত দিয়ে গেছেন। জাতির পিতার এই রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আজকের দিনে এই প্রতিজ্ঞাই আমরা করি যে, পিতা (বঙ্গবন্ধু) তোমাকে কথা দিলাম, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব। এটাই আমাদের অঙ্গীকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত দাবি করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের যোগাযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিল যে, তারা জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে ইশারা পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে খুনী মোশতাক প্রথমেই জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করেছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের এমন মনোভাব ছিল যে তাদের কিছুই হবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতারা যদি তৎকালীন পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারত তাহলে হয়তো পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের আঘাত বাঙালীর জীবনে আসত না। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি’ বলা যায় না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান ও সামরিক আইন লংঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান। বন্দুকের নলের জোরে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে জেনারেল জিয়া হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করে। এরপর তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। আর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শাসনামল ছিল অবৈধ। দেশের উচ্চ আদালত রায় দিয়ে তাদের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তাই তাদের (জিয়া ও এরশাদ) রাষ্ট্রপতি বলা যায় না, তারা হলেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় সদস্য এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও উত্তরের সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক মেরিনা রহমান এবং জাতীয় আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ। সভার শুরুতে ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র ১০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নে সারাবিশ্বই বিস্ময় প্রকাশ করেছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমরা দেশকে একটা সম্মানের জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রবৃদ্ধি অর্জনে পৃথিবীর হাতে গোনা যে কয়েকটি দেশ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে আজ অন্যতম। মূল্যস্ফীতি আমরা কমিয়ে এনেছি, দারিদ্যের হার কমিয়ে এনেছি। দেশের মানুষের আজ খাদ্যের কোন অভাব নেই। এতো অল্প সময়ে বাংলাদেশের এতো উন্নয়ন দেখে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। নীতি ও আদর্শ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করলে দেশের যে উন্নয়ন করা যায়, আমরা তা প্রমাণ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পাকিস্তানের চেয়েও শক্তিশালী। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে আমরা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পেরেছি। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। জাতির পিতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে না গেলে এসব করা সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করেই দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। জাতির পিতা বেঁচে থাকলে দেশকে উন্নত করতে এতো সময় লাগতো না। বঙ্গবন্ধু যদি আর মাত্র ৬/৭টি বছর দেশ সেবার সুযোগ পেতেন, তবে অনেক আগেই বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ হতো, দেশের মানুষকে দীর্ঘ ২১ বছরের হত্যা-ক্যু, ষড়যন্ত্র, হত্যা-নির্যাতনের মতো দুঃশাসন ভোগ করতে হতো না। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মাত্র ১৫ দিন আগে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলাম স্বামীর কর্মস্থলে। এ কারণে আমরা দু’বোন বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে হারিয়ে এ বেঁচে থাকা কষ্ট মৃত্যুর চেয়েও ভাল। ৬টি বছর দেশে ফিরতে পারিনি, অন্য দেশে রিফিউজি হয়ে থাকতে হয়েছে। সবাইকে হারিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে শুধু দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য দেশে ফিরে এসেছিলাম। দেশে ফিরে বাবা-মা, ভাইসহ পরিবারের কাউকে দেখতে পাইনি, কিন্তু দেশে ফিরে পেয়েছিলাম দেশের লাখো মানুষের ভালবাসা, স্নেহ, শক্তি ও অনুপ্রেরণা। আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী, মুজিবের আদর্শের সৈনিক, তারাই আমাকে আপন করে নিয়েছে। সেখানেই পেয়েছি আমার বাবা-মা, ভাইয়ের ভালবাসা। এখানেই আমার সবথেকে বড় শক্তি। তাই আমার একটাই লক্ষ্য, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা, তাদের উন্নত জীবন দেয়া এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কথা উল্লেখ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেষ কথা বলেছিলেন- প্রয়োজনে বুকের রক্ত দেব। আর সেই রক্তই তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই রক্তঋণ শোধ করতে হবে তাঁর স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, আজকে অন্তত এইটুকু বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে আমরা চলেছি। কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি। বাবা-মা, ভাই সব একদিনে হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে যখন যাই সবাই ছিল, যখন ফিরে আসি শূন্য। কেউ নেই। সব হারিয়ে কিন্তু পেয়েছিলাম লাখো মানুষ। তাদের আপন করে নিয়েছি। একরাতে পরিবারের সব হারানোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার গলা ভারি হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার। নিজের আবেগ সামলিয়ে তিনি বলেন, সেখান থেকেই আমরা বড় প্রেরণা পেয়েছি। দেশে ফিরে একটা জিনিসই চিন্তা করেছি। আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছেন। তাই এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। এদেশের মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে। উন্নত জীবন দিতে হবে। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে আজকে বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বে একটা মর্যাদার আসনে নিয়ে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ সারাবিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা অবাক হয় যে এতো দ্রুত কিভাবে একটা দেশ উন্নত হতে পারে। হতে পারে তখনি যখন যারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, যারা নীতি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে তারা যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলেই একটা জাতি উন্নত হয়। তাহলে একটা জাতি এগিয়ে যেতে পারে। আমরা তা প্রমাণ করেছি। কিন্তু যারা পরাজিত শক্তির দোসর তারা ক্ষমতায় থাকলে কোন জাতি এগোয় না, কোন জাতি উন্নত হতে পারে না। তিনি বলেন, আজ জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের মাঝে আছে। সেই আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করলে দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস পাবে, সম্মান পাবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতারা যদি তৎকালীন পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারতেন তাহলে হয়তো জাতির জীবনে ১৫ আগস্টের আঘাত আসতো না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের বিশাল কর্মযজ্ঞ একদিকে করা, অপরদিকে একটি দেশ, যে দেশটি ছিল পাকিস্তান নামের একটি দেশের একটা প্রদেশ। আর যে ভূখন্ডটা চিরদিন বিদেশীদের, তারাই এদেশের রাজত্ব করেছে। সেই দেশটাকে একটা দেশ হিসেবে, একটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা- এই কঠিন কাজ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি (বঙ্গবন্ধু) করে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দেশ শাসনকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেই সময় নানা চক্রান্ত চলেছে- পাটের গুদামে আগুন, থানা লুট করা, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাতজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আলবদর বাহিনী অনেকেই দেশ ছেড়ে ভেগে গিয়েছিল। অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তারা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। ওই সময়কার পরিস্থিতি তখনকার রাজনৈতিক নেতাদের উপলব্ধিতে আসেনি মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তখনকার যে একটা অবস্থা সেই অবস্থা বুঝতেই পারেননি। একটা দেশ দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিল, শোষিত ছিল, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা হয়েছে। যারা পরাজিত হয়েছে তারা এতো সহজে ছাড়বে না। তাদের দোসররা ছিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর তাদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত অব্যাহত থাকবে- এই উপলব্ধিটা তখনকার দিনে আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যেও আসেনি। তাই তারা এটা হয় নাই, ওটা হয় নাই- নানা ধরনের প্রশ্ন, কথা, লেখালেখি অনেক কিছু শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি আক্ষেপ করে বলেন, ক্ষত-বিক্ষত একটা দেশ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু একটা দেশ, সেই দেশটাকে গড়ে তোলা যে অত্যন্ত কঠিন-দুরূহ কাজ। এটা যে একদিনেই, একটা কথায় গড়ে ওঠে না- এই উপলব্ধিটা যদি সকলের মাঝে থাকত তাহলে হয়তো ১৫ আগস্টের মতো এত বড় একটা আঘাত এ দেশের ওপর আসত না। তিনি আরও বলেন, তখন কিন্তু কেউ সেই উপলব্ধিটা করে নাই, এটা উপলব্ধি করতে অনেক সময় লেগেছিল তাদের। তবে তারা ওই সময় কেন উপলব্ধি করতে পারে নাই, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক জ্ঞানী-গুণী অনেকেই আছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেন, বাহাত্তর সালের পর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত অনেক লেখালেখি আছে। কেউ যদি একবার চোখ বুলান, পড়েন তখন দেখবেন কত ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কথা তারা বলে গিয়েছিলেন। আর সেই খেসারতটা জাতিকে দিতে হলো পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল সেই আলবদর, রাজাকার, আলশামস এবং পাকিস্তানী বাহিনীর দালাল-দোসর তাদের হাতেই চলে গেল দেশের ক্ষমতা। তাদের হাতে যে ক্ষমতা চলে গেছে সেটাও বোধহয় অনেকে উপলব্ধি করতে পারেননি। শত ষড়যন্ত্র করেও যখন দেশের অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর দেশের কেন উন্নয়ন হয়নি এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা কখনও বাঙালী জাতি মাথা তুলে দাঁড়াক তা চায়নি। তারা কখনও বাঙালী জাতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চায়নি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নিতে চেয়েছিল তাদেরই চক্রান্ত ছিল। কারণ বাঙালী জাতির বিজয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, এই বিজয় এরা কখনই মেনে নিতে পারেনি। তারা দেশকে পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল যেন এক সময় বলতে পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে বা স্বাধীনতা অর্জন করে ভুল করেছে। এটাই ছিল তাদের মনে। সেইজন্য এরা কখনও বাংলাদেশকে উঠে দাঁড়াতে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব ষড়যন্ত্রকারীরা ওই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী, যারা সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের রক্ত নিয়েছে, গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের দালালি করেছে, বাঙালী হয়ে তারা ওই পাকিস্তানী হানাদার বা সামরিক শাসকদের পদলেহন করেছে। তাদের তোষামোদি করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে। তারা গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। একটা জাতিকে সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। এরাই জাতির পিতাকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্টের পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে একটি পরিবারের হত্যাকান্ড হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা এবং পরবর্তী নানা ঘটনা গোটা বিশ্বের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়, ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড একটি পরিবারের হত্যাকান্ড নয়, এই হত্যাকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ধূলিসাৎ ও একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই। বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসিত করা হয়, খুনীদের পুরস্কৃত করা হয়। খুনীরা তখন দেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাহস পায়নি পরিবর্তন করতে। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা অনেকেই জাতির পিতার বাসভবনে যাতায়াত করতো উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দুঃখের বিষয় এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তারা তো চেনা। বাংলাদেশ খুব ছোট জায়গা। দিন রাত আমাদের বাড়িতেই যারা ঘোরাঘুরি করতো তারাই তো সেই খুনীরূপে আসলো। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান একটা মেজর ছিল, তাকে প্রমোশন দিয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয়েছিল। মাসে একবার করে হলেও সে (জিয়া) আমাদের বাসায় আসতো। কখনও একা বা কখনও খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আসতো। কারণ খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আসলে মার (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) সঙ্গে দেখা করার উছিলায় বাসার ওপরে আসতে পারতো। আমাদের ওই লবিতে দুটা মোড়া পেতে বসতো। ঘন ঘন তার যাতায়াত ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, যারা বাসায় আসতো তাদের অনেকেই এই হত্যাকান্ডটা চালালো। খুনী মোস্তাক তো মন্ত্রী ছিল। পরবর্তীতে অনেক চেহারা আপনারা দেখেছেন, যারা বিএনপিতে যোগ দিয়েছে। অনেকে বড় বড় নীতির কথা এখন বক্তৃতায় শোনায়, তারা কী ছিল? তারা কী এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল না? তারা ভেবেছিল এইভাবেই বোধহয় ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে। তারা ক্ষমতায় টিকেনি। তিনি বলেন, খুনী মোস্তাক নিজেকে অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরপরই জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করলো। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, জিয়াউর রহমান কিভাবে খুনী মোশতাকের এত বিশ্বস্ত হলো যে তাকেই (জিয়া) সেনা প্রধান করলো? সেটা খুনী কর্নেল ফারুক-রশিদ বিবিসিতে যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সেই ইন্টারভিউ থেকেই সবাই জানতে পারেন। খুনীরা যে জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এবং জিয়ার কাছ থেকে তারা ইশারা পেয়েছে এবং জিয়া যে তাদের আশ্বস্ত করেছে। এগুলো করলে পরে সমর্থন পাবে- সেটা তো আত্মস্বীকৃত খুনীরা নিজেরাই বলে গেছে। এরা কারা ছিল? এরা কী স্বাধীনতা চেয়েছিল? এরা কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করতো? এরা কী যে নীতিমালা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তাতে বিশ্বাস করতো? তারা তা কখনই করতো না বলেই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকে আনা হলো। প্রশাসনের তার পক্ষে থাকলো। দেখানোর চেষ্টা করা হলো এটা পারিবারিক হত্যাকান্ড। এরপর সংবিধান সংশোধন করে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে আনা হলো। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াকে আনা হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তিনি বলেন, কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করা হলো। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড কোন পারিবারিক হত্যাকান্ড নয়, এটা রাষ্ট্রকে বিকল করার ষড়যন্ত্র। এখন শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। কেন? শেখ হাসিনা কী করলো? তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে তার উপর বারবার আঘাত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ছাত্রলীগকে বুঝতে হবে। আমাদের শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। তবে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছিল। দেশকে পিছিয়ে দিতেই দেশী-বিদেশী চক্রান্তে এই হত্যাকান্ড। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালীর অথনৈতিক মুক্তি। দেশ স্বাধীনের পর সেই কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। তার আগেই ঘাতকের দল তাকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার মতোই লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেছেন। তিনি দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, একাত্তরের পরাজিত খুনীরা জাতির পিতাকে হত্যা করে স্বাধীনতাকে অসম্পন্ন করতে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা হীনতার কারণে কিছু করতে পারিনি। খুনীরা কাপুরুষ বলেই বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মহান নেতার জন্ম না হলে আমরা স্বাধীন হতাম না। পাকিস্তানীরা সাহস পায়নি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। কিন্তু কিছু বেঈমান-মোনাফেক স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালীরা হত্যা করেছিল জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা অসীম সাহস ও ধর্য নিয়ে এই হত্যার বিচার করেছিলেন বলেই জাতি কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। অনেক বড় দেশ যারা সবসময় গণতন্ত্র ও মানবতার কথা বলে- তারাই বঙ্গবন্ধুর অনেক আত্মস্বীকৃত খুনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। ওইসব দেশের প্রধানদের বলতে চাই- আইন মানুষের জন্য, আইন পরিবর্তন করুন। খুনীদের ফিরিয়ে দিন। আজকের দিনে শপথ হোক খুনীদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করব ইনশাআল্লাহ।
×