ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা

বিএনপির দল গোছানো কার্যক্রম কোন্দলে স্থবির

প্রকাশিত: ১০:৩২, ১০ আগস্ট ২০১৯

  বিএনপির দল গোছানো কার্যক্রম কোন্দলে স্থবির

শরীফুল ইসলাম ॥ দল গোছানোর প্রক্রিয়ায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি বিএনপি। এ বছরের শুরুতে সর্বস্তরে দল গোছানোর কাজ শুরু করে ৬ মাসে মাত্র ক’টি জেলা ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কিছু ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনের পর এ নিয়ে কোন্দল মাথাচাড়া দিলে স্থবির হয়ে পড়ে বিএনপির দল গোছানোর কার্যক্রম। এর ফলে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে দল গোছানোর দাবি ওঠে। এ রকম পরিস্থিতিতে কারও সঙ্গে কোন আলোচনা না করে নেতাকর্মীদের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দল গোছানোর কাজ শুরু হওয়ায় সর্বস্তরে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেখানেই কমিটি সেখানেই কোন্দল হওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রমও প্রশ্নের মুখে পড়ে। এর ফলে এক পর্যায়ে দল গোছানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ মাস খানেক আগে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েও পিছুহটে আসেন তারেক রহমান। ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করতে চাইলে সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী রাজপথে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি বিএনপি কার্যালয়ে ভাংচুর ও দলের কিছু নেতাকে নাজেহাল করে। এ কারণে ছাত্রদল থেকে কয়েকজনকে বহিষ্কার করে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলে বহিষ্কৃতরা আরও বিদ্রোহী হয়। বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতাও বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতাদের পক্ষে অবস্থান করে। এ পরিস্থিতিতে অতি সম্প্রতি বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্কাইপি বৈঠক করে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে ঈদের পর ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের কথা জানান। তবে ঈদের পর কখন কমিটি হবে তা জানানো হয়নি। কোন্দলের ভয়ে এ কমিটিও সহসা করার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ সর্বশেষ কাউন্সিলের পর ৩ বছর ৫ মাস সময় পার হয়ে গেলেও বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের কোন উদ্যোগ নেই। বরং কাউন্সিল ছাড়া দল গোছানো কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জুন মাসে দলের স্থায়ী কমিটির ৫ শূন্য পদের মধ্যে দুটি পদ পূরণ করায় এ নিয়ে দলের ভেতর চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় কমিটির বাকি শূন্য পদগুলো পূরণ করা থেকে বিরত থাকেন দলীয় হাইকমান্ড। সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিএনপির একটি বড় অংশ জাতীয় কাউন্সিলের পক্ষে অবস্থান করলেও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন কাউন্সিলের বিপক্ষে। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল করতে গেলে দল নানামুখী সমস্যায় পড়তে পারে। আর যেহেতু শীঘই্র জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না সেহেতু তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানো কার্যক্রমও থামিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একের পর এক দলের জেলা-উপজেলা এবং বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ইউনিট কমিটি দেয়া শুরু করেছিলেন। যখন যে ইউনিটের কমিটি দেয়া হয় সেখানেই কোন্দলের কারণে একাধিক গ্রুপ পাল্টাপাল্টি কর্মকান্ড শুরু করে। আর তা করতে গিয়ে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয় দলের নেতাকর্মীরা। এদিকে বর্তমানে দল গোছানোর কাজ স্থগিত থাকায় এবং অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বিধায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। বিশেষ করে দলের নতুন কমিটিতে স্থান পেতে যারা দীর্ঘদিন ধরে আশা করে বসে আছেন তাদের মধ্যে হতাশার মাত্রা বেশি। শুধু যে দলের কমিটি পুনর্গঠন বা জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না তাই নয়, বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৬ মাস পর পর নির্বাহী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও দেড় বছর ধরে কোন নির্বাহী কমিটির সভাও হচ্ছে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে যাওয়ার আগে ৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী কমিটির সভা ডেকে দল পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর পর দলের বিভিন্ন স্তর থেকে নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার দাবি জানানো হলেও তারেক রহমানের সায় না থাকায় তা হচ্ছে না। নির্বাহী কমিটির সভায় খোলা মনে কথা বলার রেওয়াজ থাকায় তারেক রহমানের ভয় এতে তার ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা হবে এবং দলীয় কোন্দল আরও চাঙ্গা হবে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয় কাউন্সিলের দাবিও প্রবল হবে। আর তাহলে জাতীয় কাউন্সিল করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। আর খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল হলে নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। এমনকি জাতীয় কাউন্সিল করতে গিয়ে কোন্দলে জড়িয়ে কিছু নেতা দলকে ব্রাকেটবন্দীও করে দিতে পারেন। তারেক রহমান ও তার অনুসারীদের এমন আশঙ্কার কারণেই জাতীয় কাউন্সিলসহ সর্বস্তরে দল গোছানোর কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। দল গোছানো কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিএনপি হাইকমান্ড যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেরও নতুন কমিটি করতে চেয়েছিল। এ নিয়ে কয়েক মাস আগে এই দুই সংগঠনের পরবর্তী কমিটির নেতাদের একটি খসড়া তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভয়ে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি দেয়া হয়নি। আর ২ মাস আগে বগুড়া জেলা বিএনপির নতুন কমিটি দেয়ার পর দুই গ্রুপের ভয়াবহ সংঘর্ষের পর জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনের কাজও বন্ধ করে দেয়া হয়। দলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও গ্রুপিং-কোন্দলে লিপ্ত। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে একটি অংশ চায় মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিতে। আর মহাসচিব চান কিছু সিনিয়র নেতাকে উপেক্ষা করে কৌশলে দলের আধিপত্য ধরে রাখতে। আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চান তার অনুসারীদের সহযোগিতা নিয়ে অন্য সবাইকে উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে দল চালাতে। দল গোছানোর কাজ স্থবির হওয়ার এটিও একটি কারণ বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, দল গোছানোর কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সুযোগ-সুবিধা অনুসারে দল গোছানোর কাজ এগিয়ে নেয়। বিএনপি এখন চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। তাই দল গোছানোর কাজে নানামুখী বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে সময়-সুযোগ মতো আবার দল গোছানোর কাজ পুরোদমে শুরু করা হবে। এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, দলকে শক্তিশালী করতে হলে সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন দরকার। দলের মেধাবী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে সর্বস্তরে কমিটি গঠন করতে পারলে বিএনপি আবারও ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবে।
×