ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর হাতিরঝিলে হবে আন্তর্জাতিক মানের এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

থমকে গেছে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের অপেরা হাউস

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৩ আগস্ট ২০১৯

 থমকে গেছে প্রধানমন্ত্রীর  স্বপ্নের অপেরা হাউস

মনোয়ার হোসেন ॥ কংক্রিটে বন্দী এই শহরটা হয়ে উঠবে আরও বেশি নান্দনিক ও শৈল্পিক। ঢাকার বুকে জেগে উঠবে নতুন দিগন্ত রেখা। সবুজে আবৃত সুবিন্যস্ত কাঠামোয় দৃশ্যমান হবে আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঢাকা অপেরা হাউস। কুড়ি একর জায়গার ওপর নির্মিতব্য সুদৃশ্য সেই স্থাপনাটি বৈশ্বিকভাবে মেলে ধরবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার উচ্চতা ও অহঙ্কারকে। সিডনি অপেরা হাউসের আদলের কাঠমোটি বিশ্বে নতুনভাবে পরিচিত করবে এই দেশকে। আর এই প্রকল্পের স্বপদ্রষ্টা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রধানমন্ত্রীর সেই স্বপ্নের প্রকল্প এখন আক্রান্ত দীর্ঘসূত্রতার কবলে। ২০১৮ সালে গ্রহণ করা হয়েছিল পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি। ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তব রূপ পাওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। প্রাথমিক পর্যায় পেরিয়ে কর্ম প্রক্রিয়া শুরুর পথে এগোচ্ছে না প্রকল্প। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত প্রকল্পটি। সেই সুবাদে গত এক বছর কাজ করে ইতোমধ্যে শিল্পকলা একাডেমি অপেরা হাউস প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) বা উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। কয়েক মাস আগেই সেই ডিপিপি পাঠানো হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পাঠানোর কথা রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। অথচ কয়েক মাস পেরুলেও অপেরা হাউস প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো ডিপিপি পৌঁছায়নি পরিকল্পনা কমিশনে। ফলে অপেরা হাউসের জন্য হাতিরঝিল এলাকায় চিহ্নিত করা ভূমি অধিগ্রহণের কাজটিও থমকে আছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের নক্সা প্রণয়নসহ সব কাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে ঢিমে তাল। এমন অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আদৌ কি ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে অপেরা হাউসের নির্মাণ কাজ। অপেরা হাউস প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সঙ্গে। কয়েক দফা টেলিফোনে যোগাযোগ এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও পাওয়া যায়নি প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য। পরবর্তীতে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আহমেদ শিবলীর সঙ্গে। প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সেই অর্র্থে প্রকল্প নিয়ে বলার মতো অগ্রগতি হয়নি। এটি একেবারেই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির তৈরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এটি অনুমোদনের জন্য এখনও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি। কিছু কারণে এটি কমিশনে পাঠানো না গেলেও সেই কারণগুলো বলা যাবে না। আরও খুঁটিনাটি দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর ডিপিপি অনুমোদন না হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু করা যায়নি। এটি কবে শুরু হবে সেটিও এখন বলা যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অপেরা হাউস দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানী ঢাকায়ও ওই আদলের একটি আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ার রূপরেখা আসে তার মনে। সে ভাবনার বাস্তবায়নে তিনি ঢাকা অপেরা হাউস গড়ার বিষয়ে আগ্রহী হন। গ্রহণ করা হয় দেশের সংস্কৃতি খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি। স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রকল্পটি নিয়ে বৈঠক হয় তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশনের (সিএসপি) প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল আবু সায়িদ মোঃ মাসুদ এবং স্থপতি প্যাট্রিক ডি রোজারিও। তখন প্রকল্পের প্রাথমিক উপস্থাপনাটি দেখে পছন্দ করেন প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে স্বপ্নের প্রকল্প হিসেবে গৃহীত হয় ঢাকা অপেরা হাউস। সেই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সেই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই ডিপিপি প্রণয়ন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমি সূত্র জানায়, হাতিরঝিলের পশ্চিম উলন ও সিদ্ধেশ্বরী মৌজার ২০ একর জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে মহানগর প্রকল্প পার্শ্ববর্তী উন্মুক্ত স্থানে নির্মিত হবে ঢাকা অপেরা হাউস। কমপ্লেক্সের চারপাশে সুপরিসর জায়গা রেখে ১০ একর ভূমির ওপর নির্মিত হবে বিশাল আকৃতির নান্দনিক শৈলীর স্থাপনা। এতে ঠাঁই পাবে তিনি হাজার আসনের কনসার্ট হল। বড় পরিসরের সঙ্গীত বা নৃত্যানুষ্ঠানের জন্য থাকবে ১২০০ থেকে দেড় হাজার আসনবিশিষ্ট মঞ্চ। নাট্য প্রদর্শনীর জন্য থাকবে ৫০০ থেকে ৬০০ আসন বিশিষ্ট থিয়েটার হল এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেকআপ ও রিহার্সেল রুম। সেই সঙ্গে থাকবে একটি বিশাল মুক্তমঞ্চ। চোখ ধাঁধানো ভবনটিতে যুক্ত হবে রেকর্ডিং স্টুডিও। থাকবে শিশু কর্নার, আর্কাইভ, জাদুঘর, আউটডোর ভেন্যু ও ফুড কোর্ট। স্যুভিনিয়র শপে দেখা মিলবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলা নানা সামগ্রী। সিনেমাপ্রেমীদের জন্য থাকবে চলচ্চিত্র কেন্দ্র। এখানে প্রদর্শিত হবে ধ্রুপদী ও সমকালীন চলচ্চিত্র। দেশের সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে গড়া ভবনটিতে নবীন শিল্পীদের জন্য থাকবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। দর্শনার্থীসহ শিল্পীদের সুবিধার্থে থাকবে বহু স্তরবিশিষ্ট পার্কিং জোন। শুরুতে ছয় হাজার কোটি টাকার বাজেট ধরা হলেও বর্তমানে প্রাকল্পটির প্রাথমিক বাজেট আট হাজার কোটি টাকা নির্ধারিত হয়েছে। অপেরা হাউসের স্থাপত্য নক্সা করবে সুইজারল্যান্ডের স্থাপত্য সংস্থা হার্জগ এ্যান্ড মিউরন। প্রকল্পের নক্সার বিষয় ইতোমধ্যে এ দলের প্রধান তিন স্থপতি পিয়েরে ডি মিউরন, আদ্রিয়ান কেলার ও ডমিনিক ডি মিউরেনের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর বৈঠকও হয়েছে। বিশ্বখ্যাত এ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় স্থাপনার নক্সার কাজ করেছে। জার্মানির বুন্দেস লিগার চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখের স্টেডিয়াম এ্যালিনাজ এরিনা, যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিকোর এম এইচ ইয়ং জাদুঘর, চীনের বেজিং জাতীয় স্টেডিয়ামসহ সব মিলিয়ে শতাধিক স্থাপনার নক্সা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তারা ইসরাইলের জাতীয় গ্রন্থাগার, সুইজারল্যান্ডের সর্বোচ্চ ভবন রোচে টাওয়ার, কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের আর্ট গ্যালারিসহ গোটা বিশেক স্থাপনার নক্সার কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, অপেরা হাউস প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করতে ইতোমধ্যে আমরা ডিপিপি প্রণয়ন করে সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে ডিপিপি কেন অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি- সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অপেরা হাউস নিয়ে ভাবছিলেন। সিডনি, লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত অপেরা হাউস দর্শনের পর বাংলাদেশেও তিনি এটি নির্মাণের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই অপেরা হাউস নির্মাণের মাধ্যমে তাঁর সেই আগ্রহের বাস্তবায়ন ঘটবে। এটি নির্মিত হলে জাতির জন্য একটি গর্বের বিষয় যুক্ত হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে মহিমান্বিত করবে এই অপেরা হাউস। এই ভবনের জন্য বহির্বিশ্বে আলাদাভাবে পরিচিতি পাবে এই দেশ। তুলে ধরবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনা ও অগ্রগতির উচ্চতাকে।
×