ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাস ট্রেন লঞ্চে ঢাকায় ফিরছে মানুষ, ফাঁকা রাজধানী

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ৮ জুন ২০১৯

  বাস ট্রেন লঞ্চে ঢাকায় ফিরছে মানুষ, ফাঁকা রাজধানী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঈদ শেষ। ছুটির লগ্নও শেষ হওয়ার পালা। এবার ঢাকায় ফেরার পালা। সবুজ শ্যামল গ্রাম, সদ্য বৃষ্টিতে থৈ থৈ ঝিলের পানিতে উঁকি দেয়া শাপলা-শালুকের দৃশ্য আর প্রিয়জনের মুখগুলো ছেড়ে ফের কর্মস্থল রাজধানীতে ফিরতে শুরু করেছেন লোকজন। আজ শনিবার থেকেই খুলছে কিছু বেসরকারী অফিস। আগামীকাল রবিবার থেকে সরকারী অফিস খোলা। শুক্রবার সারাদিন কমবেশি মানুষ ফিরতে শুরু করলেও নগরী তার পুরনো চেহারা ফিরে পায়নি। এ সপ্তাহেই আবার মানুষে মানুষে একাকার হবে রাজধানী। সড়ক ভরে উঠবে গাড়িতে। যানজটের শহরে ফের শুরু হবে মানুষের হাঁসফাঁস। বাড়তি বাস ভাড়া, টিকেটযুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন গন্তব্য থেকে ঢাকায় ফিরছেন মানুষ। তবে রাস্তায় কোন ভোগান্তি নেই। আর যারা নানা কাজে ছুটি পাননি তাদের একটি অংশ এখন ঢাকা ছাড়ছেন। বেশি ছুটি নিয়ে সময় কাটাবেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। তাই তো ট্রেন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের বেশ ভিড় রয়েছে এখনও। এদিকে ভ্রমণপিপাসু লোকজন ঢাকার সড়কে হৈ হুল্লোড়ে সময় পার করছেন। ছুটির শুরু থেকেই বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় লেগেই আছে। লেক, পার্ক, খোলা জায়গায় দিনভর মানুষের আনাগোনা, আড্ডা চলছেই। সিনেমা হল, পার্কগুলো মানুষে ঠাসা। সদরঘাটে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোটা রীতিমতো প্রতিযোগিতার। মাঝি কম, নৌকা সংকট তবুও একটু বেড়ানো চাইই চাই। সবসময় তো আর বাইরে বের হওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাছাড়া প্রিয়জনের সঙ্গে অবসর কাটানোর সুযোগ খুবই কম আসে। তাই তো নৌকা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাড়তি আনন্দ, যদিও ভাড়া যেন মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গার শামিল। সিল্কি চুল, লাল শাড়ি, লাল টিপ- মেহেদি রাঙা হাত, উৎসব আর ভালবাসায় ঈদের ছুটিতে মিলেমিশে একাকার। নৌকায় বসে একটু খুনসুটি। একে অপরের দিকে জল ছিটানো আর বাসা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত খোলা সড়কে রিক্সায় আসা-যাওয়া ঈদের আনন্দের মাত্রাকে সত্যিই পূর্ণ করে দেয়। শুক্রবার ঢাকার হাতিরঝিল, বাসাবো বালুর মাঠ, ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বলধা গার্ডেন, বেইলি রোড, ফুলার রোড, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘরসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলোর শুধু মানুষ আর মানুষ। ভিড় দেখলে মনে হবে এই দিনগুলোর জন্যই বুঝি এতদিনের অপেক্ষা। ঢাকা নদী বন্দর সদরঘাট টার্মিনাল কথা হলো অনিতা আর হিন্দোলের সঙ্গে। ওরা জানাল, এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই সকালে দু’জন মিলে ঘুরতে বের হন। পল্টনের বাসা থেকে রিক্সায় সদরঘাট। এরপর নৌকায় চেপে ঘুরে বেড়ানো। তিন ঘণ্টার নৌকা ভ্রমণের জন্য মাঝিকে গুনতে হয়েছে এক হাজার ২শ’ টাকা। ..তবুও তৃপ্ত তারা। কারণ দুজনেই চাকরি করেন। সব সময় অর্থই বড় কথা নয়। মানসিক প্রশান্তির বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন, যা অর্থের সঙ্গে যাবে তুলনা চলে না। তবে সকাল থেকেই একেবারেই অন্যরকম ঢাকা শহর। সুনশান নীরব ব্যস্ততম সব সড়ক। কোলাহল একেবারেই নেই। ট্রাফিক ডিউটি আছে। কিন্তু গাড়ি তো নেই। ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই সবকিছু একেবারেই ঠিকঠাক। ট্রাফিক পুলিশরা এমন অবসর কতদিন পাবেন? একটু আধটু বাজার, দোকানপাট চালু হয়েছে। ফুটপাথ অলিগলিজুড়ে বসতে শুরু করেছে মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা খুব এটা নেই। চাহিদা কম, জোগান বেশি থাকায় ফলের দামও অনেকটাই সাধ্যের মধ্যে। তবে বাজারে মাছের সংকট আছে। এখনও পুরোদমে মাছ ব্যবসায়ীরা ফেরেনি। তেমন কোন ভোগান্তি ছাড়াই যারা মেগাসিটিতে ফিরে আসতে পারছেন তারা প্রত্যেকেই স্বস্তি প্রকাশ করছেন। শুক্রবার ছুটির দিনে কমলাপুর স্টেশন, বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কমবেশি মানুষ আসতে দেখা যায়। তবে তুলনামূলক বিবেচনায় ট্রেনের যাত্রীই ছিল বেশি। মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হলো নেত্রকোনা থেকে শাহজালাল পরিবহনে আসা যাত্রী সাদির মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, সব সময় ২৫০ টাকা ভাড়া হলেও আজ নেয়া হয়েছে ৩শ’ টাকা। বাস কাউন্টারের সামনে ঝোলানো সাইনবোর্ডে নতুন করে টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি টার্মিনাল থেকে টিকেট না কেটে শহরের ভেতরের কাউন্টার থেকে আগের দিন আরও ৩০ টাকা বেশি দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করেছি। সব মিলিয়ে আমাকে ৮০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শনিবার ছুটি রয়েছে। তাই ঢাকায় ফেরা মানুষের চাপ বাড়বে ৯-১০ তারিখের (জুন) দিকে। গাবতলী বাস টার্মিনালে রাজবাড়ী থেকে ঢাকায় ফিরেছেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠনের কর্মকর্তা শিবলী। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে যখন নামছিলেন তার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্যও ছিলেন। তবুও কেন জানি মন বিষণœ। বললেন, বাবা-মা, ভাই বোন সবাইকে ছেড়ে আসছি। মনটা ভাল নেই। ঈদ উপলক্ষে বছরে দু’বার সবাই একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ পাই। তারপর আবার যে যার মতো চলে যাই। এবারও বেশ আনন্দ করেছি। তিনি জানান, আসার পথে সড়কের কোথাও ভোগান্তি হয়নি। দিনাজপুর থেকে আসা যাত্রী হেলাল জানালেন, ঢাকায় ফেরা নিয়ে সব কাউন্টারেই এখন কিছুটা ভিড় আছে। বিশেষ করে সবাই এসি টিকেট চান। তারপরের পছন্দ ভাল কোম্পানির বাস। এটাও যারা মেলাতে পারছেন না তাদের তো একটা কিছু হলেই হলো। গাবতলী টার্মিনালে দেখা যায় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ রাজধানীতে ফিরতে শুরু করেছেন। হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের ঈদের আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সবাই ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরছেন। গাবতলী বাস টার্মিনালে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার শওকত আলী বলেন, এবারের ঈদে ৯ দিন ছুটি ছিল। কেউ কেউ ফিরলেও অনেকেই বাড়ি রয়ে গেছেন। হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার ম্যানেজার মিন্টু বলেন, এখন পর্যন্ত যাত্রীর চাপ তেমন নেই। ঈদে সরকারী ছুটি ৯ দিন থাকায় এখনও পুরোদমে রাজধানীমুখী মানুষের ঢল শুরু হয়নি। শুক্রবার কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনে ওঠানামায় তেমন একটা ঝক্কি-ঝামেলা ছিল না। নিয়মিত বিরতিতে ট্রেন আসে, আবার সময়মতো ছেড়ে যায় গন্তব্যে। তবে যে হারে মানুষ ফিরছে সেই হারে মানুষ এখনও ঢাকা ছাড়ছে। শুক্রবার সকাল সকাল ছয়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পঁচিশটির বেশি ট্রেন কমলাপুরে আসে। একই সময়ের মধ্যে কমলাপুর ছেড়ে যায় প্রায় ত্রিশটির মতো ট্রেন। এ সময় যাত্রীরা নির্বিঘ্নে ওঠা-নামা করতে পেরেছেন। কমলাপুরের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী বলেন, এ বছর ঈদের দিন বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আট কাউন্টারে ২৪ লাখ টাকার টিকেট বিক্রি হয়েছে। অপরদিকে ঈদের পরের দিন বৃহস্পতিবার ৬৩ লাখ টাকার টিকেট বিক্রি হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় এখনও প্রচুর মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এটা শুধু সরকারী কাউন্টারের হিসাব। এর বাইরে বেসরকারী পর্যায়ে কিছু কমিউটার ট্রেন রয়েছে বলেও জানান সীতাংশু চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ঈদের পরও ঢাকা থেকে প্রচুর মানুষ গ্রামে যাচ্ছে। দুদিক থেকেই মানুষ আসা-যাওয়া করছে। দশটা পর্যন্ত ১৭ ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। সব সঠিক সময়ে গেছে। সারাদিনে ৫৩ ট্রেন কমলাপুর ছাড়বে বলে জানান তিনি। নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে এবার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুট বাদে অন্যান্য রুটে তেমন কোন ভোগান্তি ছাড়াই মানুষ গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। কেন শেষ অবধি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভোগান্তি। এর উত্তর জানতে গিয়ে কথা হয় পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তারা জানান, ঈদের একদিন আগের রাত থেকেই অতিরিক্ত বৃষ্টি আর বাড়তি গাড়ির চাপের মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পাড়ি দিতেই সময় লেগেছে আট ঘণ্টার বেশি।
×