ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে চলছে সেহরি নাইট

শুধু খাওয়া দাওয়া নয়, গল্প আড্ডা গেট টুগেদার

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২৩ মে ২০১৯

শুধু খাওয়া দাওয়া  নয়, গল্প আড্ডা গেট টুগেদার

মোরসালিন মিজান ॥ মধ্যরাতে সপরিবারে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া। পছন্দের রেস্তরাঁয় বসে সেহরি করা। না, এখন আর নতুন কিছু নয়। বরং অন্যরকম গেট টু গেদার। দিনের বেলার চেয়ে আকর্ষণীয়। সেহরির পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব মিলে হৈ চৈ। গল্প আড্ডা। কার না ভাল লাগে? তার চেয়ে বড় কথা, যানজটের এই শহরে রাতের ঢাকাকেই বেছে নিচ্ছেন রাজধানবাসী। এ ক্ষেত্রে ভাল সুযোগ করে দিয়েছে রমজান। দেখতে দেখতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেহরি নাইট। সেহরি পার্টিও বলেন কেউ কেউ। হ্যাঁ, এই প্রবণতা সাম্প্রতিককালের। কয়েক বছর ধরে ঢাকার অভিজাত রেস্তরাঁগুলোতে এ ধরনের আয়োজন দেখা যাচ্ছে। শুরুটা কীভাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে অনুসন্ধানে নেমে মনে হয়েছে, পুরান ঢাকায় এর সূচনা হয়ে থাকতে পারে। ঢাকার ওই অংশের কোন কোন এলাকা সারা রাত কর্মচঞ্চল থাকে। ব্যবসায়িক কারণে রাতগুলো দিনের চেহারা পায়। খোলা থাকে দোকানপাট। সরু রাস্তার ধারে অসংখ্য রেস্তরাঁ। ছোট ছোট রেস্তরাঁয় গরম গরম খাবার। মোগল ঐতিহ্যের খাবারের টানে নতুন ঢাকার ভোজনবিলাসীরাও ছুটে যান। আর রমজানে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়ে যায় কয়েকগুণ। চাহিদা দেখে সেহরির জন্য স্পেশাল মেন্যু প্রস্তুত করতে শুরু করে নামীদামী রেস্তরাঁগুলোও। একটু অন্যরকম সময়। উপভোগ্য। তরুণ প্রজন্ম তাই লুফে নেয়। আর তারপর উচ্চবিত্তরা একে সেহরি পার্টিতে রূপ দেন। নতুন ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে এখন অনেক রেস্তরাঁ। এসব রেস্তরাঁয় বিদেশীদের পাশাপাশি বাঙালীরাও পরিবার পরিজন নিয়ে ডিনার করেন। রমজানে ডিনারটাই হয়ে উঠেছে সেহরি পার্টি! সেহরির জন্য আলাদা খ্যাতি পেয়েছে নর্থসাউথ রোডে অবস্থিত হোটেল আল-রাজ্জাক। মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে রেস্তরাঁটিতে পৌঁছে শুধু অবাকই হতে হলো। মধ্য রাতে দিনের কোলাহল। ছেলে বুড়ো নারী শিশু- কে নেই? সকলেই খাচ্ছেন। চলছে গল্প আড্ডা। জায়গাটা বেশ বড়। কিন্তু সেহরি করতে আসা মানুষের সংখ্যা তারও বেশি। অনেকে তাই অপেক্ষা করেছিলেন। কোন একটি টেবিল ফাঁকা হবে, হলে বসবেন। দ্বিতীয় তলায়ও বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, একইরকম ভিড়। এর মধ্যেই চলছে খাওয়া দাওয়া। আল-রাজ্জাকের সেহরির মেন্যুতে রয়েছে ভাত বিরিয়ানি রুটি। খাসির লেগ, খাসির রোস্ট, খাসির চাপ আছে। আছে চিকেন রোস্ট, চিকেন চাটনিসহ মুখরোচক খাবার। যার যেমন পছন্দ, অর্ডার করছিলেন। দাম একটু বেশি বলেই মনে হলো। কিন্তু এ নিয়ে ভাবার মতো সময় যেন নেউ কারও! গে-ারিয়া থেকে সাজ্জাদের নেতৃত্বে সেহরি করতে এসেছিলেন পাঁচ বন্ধু। ভরপুর খাওয়া দাওয়া চলছিল। এরই এক ফাঁকে কথা হয় সাজ্জাদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা প্রথমত চাচাত মামাত ভাই। তার পর বন্ধু। একসঙ্গে বড় হয়েছি। দিনের বেলায় যে যার মতো ব্যস্ত থাকি। তাই সেহরি করতে রাতে বের হওয়া। এখানে এসে খাওয়া নয় শুধু, প্রচুর আড্ডার সুযোগ হয়েছে বলে জানান তিনি। রেস্তরাঁর ম্যানেজার মোঃ জাবেদও যারপরনাই ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, ২৫ থেকে ২৭ বছর আগে হোটেলটি চালু হয়। তখন থেকেই সেহরির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তবে এখন অনেক বেশি জমজমাট। দূর-দূরান্ত থেকে সপরিবারে খেতে আসে মানুষ। একটা উৎসবের মতো মনে হয়। তিনি জানান, রাত ১২টার পর থেকে শুরু হয়ে যায় সেহরি পার্টি। রাত যত বাড়ে কাস্টমার তত বাড়তে থাকে। আল-রাজ্জাকে একসঙ্গে ৪০০ মানুষ খেতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, এর পরও সেহরির সময় বহু মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন। পুরান ঢাকার ঠাটারি বাজারে অবিস্থত হোটেল স্টারে গিয়ে দেখা যায়, পুরোদমে চলছে সেহরি। রাত তখন পৌনে দুইটা। অথচ রেস্তরাঁয় ঢুকে সেটি মনে হয় না। এখানে রাজ্জাকের চেয়েও বড় পরিসর। কিন্তু মানুষ বেশি হওয়ায় সেটি বোঝা যায় না। এখানে খাবারের মেন্যুর মধ্যে রয়েছে সাদা ভাত ও বিরিয়ানি। গরুর মাংস নেই। খাসি ও মুরগির অনেক আইটেম। বেশ মজা করেই খাচ্ছিলেন সবাই। স্টারে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ সেহরি করতে এসেছিলেন হাফিজুল ইসলাম। বললেন, দিনের বেলায় যানজটের জন্য বের হতে পারি না। বউ বাচ্চার কষ্ট হয়। তাই সেহরি করতে এখানে আসা। বিশেষ করে বাচ্চারা রাতে বের হতে পেরে খুশি বলেও জানান তিনি। অবশ্য পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরাবাজার ও নাজিমউদ্দীন রোড ঘুরে বেড়ানোর আলাদা মজা। এসব এলাকা সরা বছরই গভীর রাত পর্যন্ত সরব থাকে। রাস্তার ধারে ছোট ছোট রেস্তরাঁ। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। খেতে যান নতুন ঢাকার লোকেরা। রোজা উপলক্ষে এই আসা যাওয়া বেড়েছে। মঙ্গলবার সেহরির সময় নাজিরাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, সবক’টি রেস্তরাঁ খোলা। বিখ্যাত বিসমিল্লাহ কাবাবে মস্তবড় মুরগি ফ্রাই করা হচ্ছে। আছে গরুর চাপ। গুর্দা কাবাব। বাইরে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থেকে বসার বন্দোবস্ত করতে হচ্ছিল। গ্রীনরোড থেকে এখানে খেতে আসা ইয়াসমিন বললেন, স্বামীসহ এসেছি। ও বসার ব্যবস্থা করছে। আর অসাধারণ খাবার তো। অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই। সেহরি উপলক্ষে পুরান ঢাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলেও জানান তিনি। ধানম-িতে সেহরি পার্টির জন্য খোলা থাকছে সুলতান’স ডাইন। সীমান্ত স্কয়ার সংলগ্ন ভবনের দ্বিতীয় তলায় রেস্তরাঁটির অবস্থান। রাত ২টার কিছু পরে সেখানে ঢুকে দেখা যায়, অল্প পরিসরে সুন্দর সাজানো গুছানো রেস্তরাঁ। সব টেবিলেই খাওয়া দাওয়া চলছে। জানা গেল, নিয়মিত আইটেমগুলোই সেহরিতে পাওয়া যাচ্ছে। মেন্যুতে রয়েছে কাচ্চি, মোরগ পোলাও, প্লেন পোলাও, চিকেন রোস্ট, জালি কাবাব, বিফ রেজালা, জর্দাসহ কয়েকটি আইটেম। এখানে বৃদ্ধ বাবা মা থেকে শুরু করে স্ত্রী শিশু সন্তানসহ সবাইকে নিয়ে সেহরি করতে এসেছিলেন তানজিমুল হক। কথা প্রসঙ্গে বললেন, এক মাস সেহরি করি। সব দিন একরকম হলে চলে? তাই সবাইকে নিয়ে বাইরে সেহরি করতে এসেছি। বাবা মা শ্যামলীতে নিজের বাসায় থাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেহরি উপলক্ষে মধ্য রাতে আমাদের একটা গেট টু গেদার হয়ে গেল। রেস্তরাঁটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফয়সাল আহমেদ জানান, এখানে একসঙ্গে প্রায় দেড়শ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু সেহরি নাইট দিন দিন আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। এ কারণে রাত একটু বেশি হলেই আর গেস্ট রিসিভ করতে পারছেন না। এ কারণে গেস্টদের আগে বুকিং দিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি। বনানী গুলশান ও উত্তরা এলাকায় এখন অনেক রেস্তরাঁ। তবে সব সেহরি পর্যন্ত খোলা থাকে না। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোর পরিবেশ সুন্দর। নিরিবিলি। একইদিন মধ্য রাতে গুলশানের প্রিমিয়াম সুইটস রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখা গেল, ভীষণ পরিপাটি। সাজানো গোছানো পরিবেশ। মূলত মিষ্টির ব্র্যান্ড। সঙ্গে রেস্তরাঁ। টপ ফ্লোরে অবস্থিত রেস্তরাঁর বিফ খিচুরি খুব স্পেশাল। আছে চিকেন খিচুরিও। রুটি বা পরটা চাইলে, পাবেন। আছে আরও কিছু সুস্বাদু খাবার। তাতেই সুন্দর সেহরি হয়ে যাবে। আর যারা মেজবানি পছন্দ করেন তাদের জন্য আছে ‘চিটাগাং এক্সপ্রেস।’ রেস্তরাঁটির ব্যবসায়িক পার্টনার মফিজুর রহমান জানান, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি গোস্ত, মেজবানি ডাল, পায়া, কালাভুনা, চিকেন রোস্ট, আখনি, বিরিয়ানিসহ অনেক সুস্বাধু খাবার আছে তাদের মেন্যুতে। ভোজনরসিকরা প্রতি রাতেই খেতে ভিড় করছেন। এসবের বাইরে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবসহ অভিজাত অনেক ক্লাব ও হোটেলে সেহরি পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে প্রতিদিন। তবে চেনা জানা রেস্তরাঁগুলোতে ভিড় বেশি। এই ভিড় ঠেলতে গিয়ে সেহরি করার মজা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। তাই আগে ভাল করে খবর নিয়ে রেস্তরাঁ পছন্দ করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন অভিজ্ঞরা।
×