ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৯ মে ২০১৯

টাঙ্গাইলে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে

ইফতেখারুল অনুপম ॥ টাঙ্গাইলে ভয়াবহভাবে বেড়েছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন। জেলায় গত এপ্রিলে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ। ঘটনাগুলো সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের উদাহরণ হিসেবে দেখছে সুশীল সমাজ। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, উপযুক্ত বিচার হলে এই ধরনের হয়ত হতো না। এসব বিষয়ে দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ অধিকাংশ অভিযুক্তকে আটক করেছে। অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন। এপ্রিলে আলোচিত ঘটনাগুলোর মামলা সূত্রে জানা যায়, জেলার গোপালপুরে নানারবাড়ি বেড়াতে আসা এক পাকিস্তানী কিশোরী (১৭) চাচাত ভাই কর্তৃক অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিশোরীর মা গত ১৭ এপ্রিল বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ ধর্ষক আল আমিন, তার ভাই সুমন ও মা আনোয়ারা বেগমকে গ্রেফতার এবং অপহৃত পাকিস্তানী কিশোরীকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘটনার মূল আসামি উত্তর গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেনের বখাটে ছেলে আল আমিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। গোপালপুরে সিনেমায় নায়িকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে এক কলেজছাত্রীকে (১৯) আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ফারুক শিকদার আকাশকে আটক করেছে পুলিশ। সে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার মাইটকুমরা গ্রামের কাইয়ুম শিকদারের ছেলে। এ ঘটনায় গত ১৪ এপ্রিল রাতে গোপালপুরের ভোলারপাড়া গ্রাম থেকে ছাত্রীকে উদ্ধার করে ধর্ষককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী। পরদিন মেয়ের বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। সখীপুরে প্রেমিকের সামনে প্রেমিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষণের প্রধান আসামি সাদ্দামকে (২৭) গ্রেফতার করেছে র‌্যাব সদস্যরা। গত ৫ এপ্রিল ভোরে টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টাঙ্গাইল র‌্যাব-১২ সিপিসি-৩ এর কোম্পানি কমান্ডার শফিকুর রহমান। এদিকে সখীপুরে বিধবা নারী নাজমা (৪২) হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। ৬ জন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। গত বছরের ৫ অক্টোবর নিজ বাড়ির টয়লেটের ভেতর থেকে নাজমার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ২০ এপ্রিল হত্যা মামলায় আলমগীরকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। এদিকে গত ২৩ এপ্রিল সখীপুরে ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মিজানুর রহমান নামের এক শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। সে উপজেলার লাঙ্গুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। টাঙ্গাইল শহরে গত ১২ এপ্রিল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকার ডিসি লেকসহ বিভিন্নস্থানে নিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় রাতেই ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮ আসামির মধ্যে ৬ জনকে আটক করেছে। ৬ জনের মধ্যে ৩ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। অন্য ৩ জনকে রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। নাগরপুরে গত ১৪ এপ্রিল প্রেমিকাকে বৈশাখী মেলায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কৌশলে বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে এক ছাত্রীকে (১৬) ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ধর্ষণকারী ও ধর্ষণে সহযোগিতাকারীকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আটক করে পুলিশ। অভিযুক্তরা হলো- উপজেলার বেকড়া গ্রামের মৃত আব্দুর রউফের ছেলে মোবারক হোসেন (২০) ও তার সহযোগী একই উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মিয়ার ছেলে রাজিব মিয়া কালু (২২)। পরে ধর্ষিতার বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। কালিহাতী পৌরসভার উত্তর বেতডোবায় ধর্ষণের শিকার হয় ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সপ্তম শ্রেণীর এক হিন্দু ছাত্রী। পরে গ্রাম্য সালিশে ওই ছাত্রীকে গ্রামছাড়া করা হয়। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে এলে ধর্ষিতার মা বাদী হয়ে কালিহাতী থানায় মামলা দায়ের করেন। এদিকে কালিহাতীর এলেঙ্গাতে তৃতীয় শ্রেণীর মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। গত ২৩ এপ্রিল এ বিষয়ে কালিহাতী থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। হোটেল ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেনের ছেলে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া কালিহাতীর নারান্দিয়ায় চতুর্থ শ্রেণীর এক হিন্দু ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। ঘটনার দেড় মাস অতিবাহিত হলেও ফরমান আলীর ছেলে আসামি বখাটে রাসেল মিয়াকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। দেলদুয়ারে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন ওই ছাত্রীর মা। উপজেলার কোপাখি গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে অভিযুক্ত কাইয়ুম পাখির বাসা দেখানোর কথা বলে ছাত্রীটিকে বাগানে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পুলিশ আসামিকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। ভূঞাপুরে গত ১ এপ্রিল দুপুরে উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নে বাসুদেবকোল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে কুপ্রস্তাব ও শরীরের আপত্তিকর স্থানে হাত দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল দুপুরে ওই শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীর পরিবার থেকে ভূঞাপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ভূঞাপুরে মেয়েদের উত্ত্যক্ত ও শরীরে বডি স্প্রে দেয়ার অপরাধে পাঁচ ইভটিজারকে অর্থদন্ড ও অনাদায়ে কারাদন্ড প্রদান করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঝোটন চন্দ। ধনবাড়ীতে স্কুলছাত্রকে অপহরণ করে যৌন নির্যাতন ও মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে তিন যুবক। সে ধনবাড়ী সরকারী নওয়াব ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র। এ ঘটনায় স্কুল ছাত্রের বড় ভাই বাদী হয়ে থানায় মামলা করলে গত ২৪ এপ্রিল পুলিশ তিন বখাটেকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। এদিকে ধনবাড়ীতে ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ওয়াসিম নামের এক মাদকাসক্ত যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ২৭ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মেয়েটির মা বাদী হয়ে ধনবাড়ী থানায় মামলা করেছে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে স্কুল ছাত্রীকে (১৪) ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে দুই সন্তানের জনক সোহেল রানার বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে ধনবাড়ী উপজেলার পাইস্কা ইউনিয়নের দড়িচন্দবাড়ী চরপাড়া গ্রামের সোহেল রানার মুদি দোকানে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি স্থানীয় একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যলয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। ধর্ষক সোহেল রানা দড়িচন্দবাড়ী চরপাড়া গ্রামের আয়নাল হকের ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ ধর্ষক সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৭ মে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। এছাড়া ওই স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। এ ব্যাপারে স্কুল ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে ধনবাড়ী থানায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পারখী ইউনিয়নের পূর্বাসিন্দা গ্রামের স্কুল ছাত্রীর ধর্ষক ও সহায়তাকারীকে পুলিশ আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। ২ মে রাতে বিষয়টি মীমাংসার জন্য ইউপি সদস্য কদ্দুস ও আওয়ামী লীগ নেতা খসরু ও মাতাব্বর সাইফুল ইসলাম সালিশের মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে। হুমকিধমকি দিয়ে ধর্ষিতা পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পুলিশ সালিশের মাতাব্বরদের চাপ দিয়ে তাদের সহযোগিতায় পুলিশ ধর্ষিতা পরিবারের লোকজনকে উদ্ধার করে মামলা নেয়। ৭ মে ভোর রাতে পুলিশ ওই ধর্ষিতার ধর্ষণকারী ও গর্ভপাত নষ্টকারীকে আটক করে। আটককৃতরা হলো- পারখী ইউনিয়নের পূর্বাসিন্দা গ্রামের রায় মোহনের ছেলে রাম প্রসাদ (২০) ও ধর্ষকের ফুফাত বোন রত্না সূত্রধর (২৫)। ধর্ষিতের বাবা বাদী হয়ে রাম প্রসাদ ও রত্না রানীকে আসামি করে থানায় মামলা করেছে। বঙ্গের আলীগড়খ্যাত টাঙ্গাইলের সরকারী সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর শহীদুজ্জামান মিয়া বলেন, সামাজিক মূলবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্যই ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। সেই সঙ্গে মাদক ও ইন্টারনেটের কু-ব্যবহার বৃহৎভাবে দায়ী। এতে আমাদের প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন থেকেই যথাযথ পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষার প্রয়োজন। বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তনও দরকার। এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের সকলকে সচেতন ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ আহাদুজ্জামান মিয়া বলেন, অভিযুক্ত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
×