ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির তালিকা তৈরি

আওয়ামী লীগের জেলা উপজেলা কমিটির সম্মেলনের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ১০:১১, ১৮ মে ২০১৯

 আওয়ামী লীগের জেলা উপজেলা কমিটির সম্মেলনের প্রস্তুতি

ওয়াজেদ হীরা ॥ সংগঠনকে আরও সুসংগঠিত করতে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সেই সঙ্গে ঈদের পর মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার কমিটির সম্মেলন করতে প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। ইতোমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলার সম্মেলন আয়োজনের তোড়জোড় চলছে আওয়ামী লীগে। ঈদের পরপরই জোরেশোরে মাঠে নামতে প্রস্তুতি রয়েছে দলটির। দলের ২১তম কাউন্সিলকে সামনে রেখে সে হিসাব করেই এগুচ্ছে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে ৭৭টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে যেসব জেলা ও উপজেলার কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে সেসব কমিটির একটি তালিকা তৈরিরও কাজ শুরু হয়েছে। এরপর জাতীয় কাউন্সিলের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটির সম্মেলন সম্পন্ন করার চিন্তা রয়েছে দলটির। তৃণমূলে হাইব্রিডদের নিয়ে দেয়া হচ্ছে সতর্ক বার্তাও। জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সফরের মধ্য দিয়ে ১১ মে থেকে খুলনা বিভাগের জেলাসমূহে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফর শুরু হয়। আগামী ২১ মে ঝিনাইদহে বর্ধিত সভার মাধ্যমে এই সফর শেষ হবে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তৃণমূল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নানামুখী বিষয় নিয়ে কথা বলছেন ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। পাশাপাশি ‘হাইব্রিড’দের নিয়ে দেয়া হচ্ছে সতর্কবার্তা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে হাইব্রিডদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি হাইব্রিড এবং দলে অনুপ্রবেশ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলটিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত হত্যার ঘটনায় জড়িত সাবেক জামায়াত নেতাকে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থন দেয়ার বিষয়টি সামনে আসায় হাইব্রিড ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে নেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত মাসে একাধিক সমাবেশে দেয়া তার ভাষণে বলেছেন, এখন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। হাইব্রিডদের বিষয়ে করণীয় নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জানান, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতসহ অন্য কোন দলের বিতর্কিত নেতারা কোথায় কোথায় অনুপ্রবেশ করেছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে এদের দল থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে সারাদেশে দলকে শক্তিশালী করার কাজ চলবে, একই সঙ্গে চলবে শুদ্ধি অভিযান বলে জানিয়েছেন হানিফ। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র মতে, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই মূলত অন্য দল থেকে বা অতি উৎসাহীরা আওয়ামী লীগে ভিড়তে শুরু করে। শুরুর দিকে এই অনুপ্রবেশকারী সুবিধাবাদীদের হার কম থাকলেও টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর তা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোল বোমায় মানুষ হত্যাসহ আন্দোলনের নামে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত জামায়াত-বিএনপির অনেক নেতা আওয়ামী লীগে ভিড়তে শুরু করেন। সূত্রগুলো আরও বলছে, ২০১৬ সাল এমনকি ২০১৭ সালেও বিএনপি-জামায়াতের এসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। নানা অঘটনের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধও বাড়াতে থাকেন তারা। এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে শুরু করেন দলের নীতিনির্ধারকরা। দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার এসব সুবিধাবাদী সম্পর্কে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আরও কঠোর অবস্থানে রয়েছে এসব হাইব্রিডারদের নিয়ে। দলটিকে পরিচ্ছন্ন ও আরও বেশি সুসংগঠিত রাখতেই হাইব্রিড তালিকা করাসহ এদের ছেটে ফেলার চিন্তা করছে দল। এদিকে আওয়ামী লীগের ২১তম কাউন্সিলের আগে বিভিন্ন মহানগর, জেলা উপজেলা নতুনভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় করতে সম্মেলন করবে দলটি। নতুন নেতৃত্ব উঠে আসলে দল নতুনভাবে আরও বেশি উজ্জীবিত হবে বলেও মনে করছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। ইতোমধ্যেই দলের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিতর্কিত বা অনুপ্রবেশকারীরা যেন ত্যাগী নেতাদের ছুড়ে না ফেলে। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। দলকে সুসংগঠিত করার চেষ্টায় আছি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বেশ কিছু জেলা-উপজেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে রংপুর ও নীলফামারী জেলার পাঁচটি উপজেলার সম্মেলনের তারিখ দেয়া হয়েছে। রমজান মাসে সম্মেলন উপলক্ষে সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন থাকবে না। রোজার ঈদের পরেই এবং জাতীয় সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ সব জেলা-উপজেলার সম্মেলন শেষ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। দলীয় সূত্র মতে, আগামী অক্টোবরে দলের কাউন্সিল সামনে রেখেই মূলত প্রস্তুতির জন্য আটটি বিভাগে আটটি টিম গঠন করা হয়েছে। আর এই টিমগুলোই সাংগঠনিক সফর শুরু করেছে। এই টিম জেলা-উপজেলায় সফর করবে ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলনের কাজ শেষ করবে। জানা গেছে, গত এপ্রিলে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিল শেষ করার তাগিদসহ সার্বিক প্রস্তুতির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সেই যৌথসভায় উপস্থিত নেতাদের দ্রুত সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে দলের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং, বিভেদ মিটিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে সাংগঠনিক সফরকালে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে সর্বত্র বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানোরও নির্দেশ রয়েছে বলেও জানা গেছে। ইতোমধ্যেই নীলফামারী ও রংপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সভা থেকে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে জেলা সম্মেলন শেষ করার প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়। জেলা-উপজেলা সম্মেলনের পাশাপাশি দলের নিষ্ক্রিয় ও মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনের কমিটির ব্যাপারেও আলোচনা হয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা। গত মঙ্গলবার দলের সম্পাদকমন্ডলীর সঙ্গে সহযোগী সংগঠন ও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক যৌথসভায় মাহাবুব-উল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে জানান, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সম্মেলন দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তৃণমূল থেকে সংগঠনকে ঢেলে সাজারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলের যৌথসভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে হানিফ আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা আশা করছি, আমরা আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে ঢেলে সাজিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করতে পারব। যথাসময়ে আগামী অক্টোবরেই আমাদের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। দলের একাধিক সূত্র জানায়, রমজান মাস চলায় এ মাসে দলীয় তেমন কোন কর্মসূচী থাকছে না। ঈদের পরেই জোরেশোরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হবে। আগস্ট মাসজুড়ে শোকের কর্মসূচি থাকায় ওই মাসে কোন সম্মেলন হবে না। ফলে এর আগে জুলাই মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ জেলা সম্মেলন শেষ করা হবে। রমজানে কিছু জেলায় সাংগঠনিক সফর হলেও জেলা সম্মেলনের কোন সম্ভাবনা নেই। ইতোমধ্যেই চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদের বিদেশে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব-উল আলম হানিফের নেতৃত্বে নোয়াখালী জেলা সফর করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেই সফরেও নেতাকর্মীদের বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, যথাসময়ে জাতীয় কাউন্সিলের ব্যাপারে অনড় দলীয় প্রধান। দলের সিনিয়র নেতাদের প্রধান এবং বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদকদের সমন্বয়ক করে গঠিত টিমগুলো সারাদেশে সফর ও সম্মেলন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা জেলা নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে জেলা সম্মেলনের তারিখ ঠিক করবেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তুলে আনার প্রক্রিয়াও চলমান থাকবে।
×