ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের যুদ্ধাস্ত্র, দেখে পিলে চমকে যায়

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১৮ মে ২০১৯

ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ    শতকের যুদ্ধাস্ত্র, দেখে  পিলে চমকে যায়

মোরসালিন মিজান ॥ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আলাদা গ্যালারি। নতুন করে সাজানো। প্রথমে মনে হয়েছিল ছাল ওঠা কাঠের বন্দুক, জং ধরা রুগ্ণ তরবারি বা এখানে ওখানে পরে থাকা কামান আরও একবার দেখা হবে। দেখা যাক। কিন্তু জাতীয় জাদুঘরের তৃতীয় তলার গ্যালারিটিতে প্রবেশ করতেই অন্য ছবি। আগে কোনদিন দেখা হয়নি এমন অস্ত্রের বিপুল সম্ভার। বহুকালের পুরনো বটে। ধার অনুমান করা যায়। আকারে যেমন বড়, আকৃতির দিক থেকে তেমনই বিচিত্র এবং ভয়ঙ্কর। শত্রু নিধন নয় শুধু, কষ্ট দিয়ে মারার এমন আয়োজন দেখে পিলে চমকে যায়। তবে জাদুঘর উপস্থাপন করছে অমূল্য নিদর্শন হিসেবেই। বিভিন্ন সময় ও কালে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব সংঘাত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস তুলে ধরছে ২৩ নম্বর গ্যালারি। জানা যায়, এখানে আগে থেকেই ছিল অস্ত্রশস্ত্র গ্যালারি। ২০১৪ সালে আধুনিকায়নের কাজ করার সময় এটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে খুলে দেয়া হলেও নিদর্শনশূন্য ছিল। গ্যালারিটিতে অস্থায়ী প্রদর্শনী আয়োজনের নতুন রেওয়াজ চালু করেন জাদুঘরের তৎকালীন মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। এত বড় রদবদল তিনি নিজের একক সিদ্ধান্তে করতে পারেন কিনা তা নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এবং অতঃপর আজ শনিবার আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে নতুন করে যাত্রা শুরু করছে অস্ত্রশস্ত্র গ্যালারি। সকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এর আগে গত বুধবার গ্যালারি ঘুরে দেখা যায়, পুনঃসজ্জার কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছে। দেয়ালজুড়ে দাঁড়িয়ে গেছে গ্লাসশোকেস। তার ভেতরে বিশেষ কায়দায় নিদর্শন স্থাপন করা হয়েছে। খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে কিছু। সব মিলিয়ে ১৮০টি নিদর্শন। জাদুঘরে সংরক্ষিত ১হাজার ৪৭টি অস্ত্র হতে এগুলো বাছাই করা হয়েছে। ধাতব তৈরি অস্ত্র এখনও চকচক করছে। কত রকমের তরবারি, দেখে শেষ করা যায় না! অবয়ব প্রায় এক। হাতলে নানারকম কাজ করা। কোন কোন তরবারির বাঁট প্রাণীর মস্তকের আদলে তৈরি করা হয়েছে। খাপের দুই পাশে লতাপাতার নক্সা। একেবারেই নতুন দেখা একটি তরবারির নাম জুলফকার। এটি ঊনিশ শতকের নিদর্শন। শমসির নামের আরকেটি তরবারি ১৮ শতকের। গ্যালারিতে বেশ কয়েকটি ছোরা ও কিরিচ পাশাপাশি সাজানো আছে। এগুলোর হাতলেও সুন্দর কারুকাজ করা হয়েছে। দেখার মতো। মস্ত বড় রাম দা আছে। যুদ্ধে ব্যবহৃত বিশেষ কুঠার দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে। আকৃতির দিক থেকে একেকটি একেক রকমের। বর্শাও তা-ই। এত লম্বা আর ভারি বর্শা কী করে উপরে ছোড়া সম্ভব হতো, ভাবলে অবাক হতে হয়। এ প্রজন্মের অনেকেই গদা শব্দটি শুনেছে। দেখেনি। গ্যালারিতে আছে শুকতারা নামের একটি গদা। ধাতব দ-ের উপরিভাগে খাঁজকাটা গোলাকার অংশের জন্যই শুকতারা নাম। গুরুজ দেখেও অবাক হতে হয়। এই ধাতবদ-ের উপরিভাগে শিংযুক্ত ষাঁড়ের মস্তকের আকৃতি। খড়ক, অংকুশ, গুপ্তি, জম্বিয়, কিন্দুজাল, গুপ্তি, অংশুক নামের অস্ত্রও দর্শনার্থীকে কৌতূহলী করবে। সিনেমায়-নাটকে যে বিশেষ পোশাক পরে যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের ছুটতে দেখা যায়, সেই শিরস্ত্রাণ ও বক্ষাচ্ছাদন রাখা হয়েছে গ্যালারিতে। পারস্য স¤্রাট দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের শিরস্ত্রাণ ও ঢাল এখনও অক্ষত। আঠার শতকের বেশ কিছু বন্দুক আছে গ্যালারিতে। অত্যন্ত সরু দেখতে বন্দুকের নাম মাস্কেট। পিস্তলের নাম মাস্কেটুন। গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ঈশা খাঁ ও শের শাহ’র আমলের কামান। সম্রাট আকবরের ৪৫তম রাজ্যাংশের লিপি সংবলিত নাকাড়া বসানো হয়েছে মেঝেতে। এটিও খুব আকর্ষণ করবে দর্শনার্থীদের। গ্যালারিটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখছিলেন বিভাগের কীপার নূরে নাসরিন। তিনি জানান, বেশিরভাগ অস্ত্র নিদর্শন পাওয়া হয়েছিল ভলদার জমিদার ও ভলদা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে। তার সংগ্রহে থাকা অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় সবই জমা পড়েছিল তৎকালীন ঢাকা জাদুঘরে, বর্তমানে যেটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নামে পরিচিত। এসব অস্ত্রশস্ত্র ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকে তৈরি ও ব্যবহৃত হয়েছিল বলেও জানান তিনি। নতুন করে গ্যালারি চালু করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহম্মদ বলেন, অস্ত্রশস্ত্র গ্যালারি নিয়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের বাড়তি আগ্রহ ছিল। গ্যালারিটি পুনরায় চালু করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন সময়। এ কারণে অনেক বেশি সমৃদ্ধ একটি গ্যালারি উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। নতুন গ্যালারি ঘুরে দেখার জন্য সকলকে আমন্ত্রণ জানান মহাপরিচালক।
×