ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে চলছে কম্বিং অপারেশন, গ্রেফতার ৭

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৫ মে ২০১৯

জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে চলছে কম্বিং অপারেশন, গ্রেফতার ৭

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে কম্বিং অপারেশন চলছে। গত চার দিনে দুটি পৃথক অভিযানে সাতজন জালনোট কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা দেশীয় জালমুদ্রা কারবারি। উদ্ধার হয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকার জালনোট। জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। জালমুদ্রার আগ্রাসন ঠেকাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তির চার বছর হতে চলছে। চুক্তি মোতাবেক দুই দেশেই কম্বিং অপারেশন চলমান থাকায় প্রতিমাসে আন্তর্জাতিক জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতারের সংখ্যা গড়ে ৬০ জন থেকে ১০ জনে নেমে এসেছে। দুই দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত ১২ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে জালনোট প্রতিরোধে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের জাল ও অচল নোট প্রতিরোধ ও পর্যালোচনা কোষ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাটি জারি করে। তাতে বলা হয়েছে, ঈদ বা বড় উৎসব এলেই জালনোট কারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। নিদের্শনায় ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত ভিডিও চিত্র প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় ও রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। রমজান মাসজুড়ে জনসমাগমস্থলে বা রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টা এ ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করতে হবে। ঢাকাসহ সারাদেশের ৫৬টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভিডিও প্রচারের তারিখ ও স্থান সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট তারিখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে এ ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এসেছে। সেই নির্দেশনা মোতাবেক কম্বিং অপারেশন চলছে। অপারেশনে গত ১০ মে ডিবি পুলিশ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানার পূর্ব রসুলপুর এলাকা থেকে জীবন ওরফে সবুজ (২৮), জামাল উদ্দিন (৩২) ও বাবুল ওরফে বাবু (২৪) নামের তিনজন জালনোট প্রস্তুতকারীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে ৪৬ লাখ টাকার জালনোট উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা রোজায় কেনাকাটা বেশি হওয়ার সুযোগে এবং ঈদকে সামনে রেখে জালনোট জড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। গত ১৩ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকার জালনোটসহ ডিবি পুলিশ হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব মোল্যা (৪৮), মিন্টু ব্যাপারী (৩২), রুবেল ব্যাপারী (৩২) ও দুলাল মিঞাকে (৬০) গ্রেফতার করে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জালমুদ্রার কারবারিদের ধরতে কম্বিং অপারেশন চলমান আছে। এ সংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত আদান প্রদান হচ্ছে। ভারতের দেয়া তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে কম করে হলেও ২০টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আবার বাংলাদেশের দেয়া তথ্য মোতাবেকও ভারতেও বহু কম্বিং অভিযান পরিচালনা করেছে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জালমুদ্রার আগ্রাসন কমাতে পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জালমুদ্রায় পাকিস্তানী গ্রেফতারসহ নানা ইস্যুতে সরকারের তরফ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করে দিতে পাকিস্তানের কোন সংস্থা চেষ্টা করে থাকে। তারই প্রেক্ষিতেই সরকারের এমন অবস্থান। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামের দেয়া তথ্য মোতাবেক, গত কয়েক বছরে অন্তত সাড়ে ৫শ’ দেশী-বিদেশী জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। যারমধ্যে অন্তত সাড়ে ৪শ’ বিদেশী। এদের অধিকাংশই আফ্রিকান। উদ্ধার হয়েছে দেশী-বিদেশী বিপুল অঙ্কের জালমুদ্রা এবং জালমুদ্রা তৈরির সরঞ্জাম। জালমুদ্রার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে কম্বিং অপারেশন অব্যাহত আছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় হামলার পর অপারেশনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। কারণ জালমুদ্রার ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই জঙ্গী। বিশেষ করে জেএমবির তৈরি জালমুদ্রা এতটাই নিখুঁত যে তা আসল না নকল তা ধরা কঠিন বিষয়। সম্প্রতি জালমুদ্রা কারবারিদের গ্রেফতারের হার অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় কম। যা জালমুদ্রার আগ্রাসন কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জালমুদ্রা কারবারিদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে জানিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলছেন, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী প্রায় দুই হাজার জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৭ কোটি জাল টাকা ও সমপরিমাণ জাল টাকা ছাপানোর সরঞ্জাম, ৫ কোটি জাল ভারতীয় রুপী, ৪ লাখ জাল ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের জালমুদ্রা। জালমুদ্রা আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের বিধান আছে। পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রগুলো বলছে, জালমুদ্রা সংক্রান্ত ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার জন গ্রেফতার হয়েছে। প্রতিমাসে জালমুদ্রা সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতারের হার গড়ে ১০ থেকে ১২ জন। আগে মাসে গড়ে অন্তত ৬০ জন। বাংলাদেশের ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে হালনাগাদ জালনোট সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলাই ২০১৫ সালের আগে দায়েরকৃত। ২০১৫ সালের পর গত প্রায় চার বছরে মামলা হয়েছে প্রায় তিন শ’। জালমুদ্রার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখার চারজন কর্মকর্তাসহ দশজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, চোরাচালান প্রবণ স্থল সীমান্তে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেসব সীমান্ত পয়েন্টে জালমুদ্রা পাচার হয়, সেসব সীমান্ত ভারত সরকারের তরফ থেকে যে সময়ে চোরাচালান হয়, সেই সময়ে সিল করে দেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিজিবি) সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিএসএফ) সে দেশটির সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই যৌথ টহল ও স্থায়ী চেকপোস্ট বসানোর প্রস্তাব রয়েছে। এসব পয়েন্টে নির্দিষ্ট সময়ের পর অনেকটা কারফিউ জারির বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলছে দুই দেশের মধ্যে। সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফের যৌথ টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি ও বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
×