ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোমল হাতে তৈরি, সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কারুকাজ-পুন্ড্র সভ্যতার উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১৪ মে ২০১৯

কোমল হাতে তৈরি, সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কারুকাজ-পুন্ড্র সভ্যতার উত্তরাধিকার

সমুদ্র হক॥ দূর অতীতে লুকিয়েছিল। নিকট অতীতে সম্মুখে এসেছে। গত শতকের শেষে গরিব ধনীর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকলের ঘরে পৌঁছেছে। একুশ শতকের শুরুতে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এগিয়ে চলেছে বিশ্বপানে। এই হচ্ছে বগুড়ার চিকন সেমাই। জেলা ব্রান্ডিংয়ে বগুড়ার পরিচিতি ‘ল্যান্ড অব পুন্ড্র সিভিলাইজেশন’। প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর সভ্যতার অভিযাত্রায় অনেক কিছু এসেছে। বগুড়ার দই দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব দুয়ারে প্রবেশ করেছে অনেক আগে। ধারাবহিকতায় বগুড়ার নিভৃত গ্রামের নারীর হাতের সুক্ষ্ম ও নিখুঁত কারুকাজে তৈরি চিকন সেমাই অবাক করে দিয়েছে। রমজান শেষের ঈদের দিনে বগুড়ার চিকন সেমাই না হলেই নয়। এই ডিমান্ড শুধু বগুড়ার নয়। দেশজুড়ে। বছর কয়েক হয় প্রবাসী বাঙালীরা বিশেষ করে মার্কিন প্রবাসীরা বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের বায়না ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনদের কাছে মেসেজ দিচ্ছে। এই শুকনো খাবার কিভাবে পাঠানো যায় এ নিয়ে ভাবছে স্বজনরা। অতীতে যে সেমাইয়ের কদর ছিল স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে সেই চিকন সেমাই এখন মুখ তুলে উঁচু আসনে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের গর্বিত পরিচয়ে পৌঁছেছে। এখন গ্রামের হাট বাজার থেকে নগরী মহানগরীর শপিংমল হয়ে রাজধানীর পাঁচ তারকা খচিত হোটেলে মেলে বগুড়ার চিকন সেমাই। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সকলের ঘরে সমান প্রিয়। শিশু থেকে বয়স্ক সকলের চিকন সেমাই চাই। গেল ক’বছর ধরে ঈদের ‘গিফটের’ তালিকাভুক্তি হয়েছে। দূর অতীতে বগুড়ার গ্রামের নারী কাপড় কাঁচার বড় পিড়ি পরিষ্কার করে তার ওপর ময়দা ছেনে হাতের তালুর সুক্ষ্ম দলনে বানাতো এই সেমাই। নিখুঁত হাতের শৈলীতে তৈরি সেমাই এতটাই চিকন যে ভাবনাতেও আসত না হাতে বানানো। গেল শতকের ৮০’র দশকেও কদর ছিল না। ঈদের দু’একদিন আগে গ্রামের কিষান বধূর হাতে তৈরি এই সেমাই কৃষক কেউ ডালায় ভরে কাঁধে, কেউ ভাড়ে করে নিয়ে আসত শহরে। বসত পথের ধারে। তখন শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও এই সেমাই কিনত না। দিনমজুর, স্বল্পআয়ের লোকজনই ছিল এই সেমাইয়ের মূল ক্রেতা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই চিকন সেমাই মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। শহরের কিছু দোকানিও এই সেমাই তোলে। সুদূর প্রসারী ভাবনায় বগুড়ার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ দুই মোটরে চালিত সেমাই বানানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে। দিনে দিনে গ্রামে ও শহরে এই চিকন সেমাই তৈরির বিস্তার ঘটে। চাহিদাও বাড়ে। বগুড়া ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যায়। চাহিদার প্রয়োজনে সেমাই তৈরির যন্ত্র বড় আকারে বিদ্যুতে চালিত আধুনিকায়ন হয়ে যায়। চিকন সেমাইয়ের পরিচিতি ছাড়িয়ে পড়ে দেশে ও বিদেশে। যারা বগুড়ার বাইরে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকেন যারা ঈদে বাড়িতে আসতে পারেন না তারা আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনের কাছে চিকন সেমাই পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে যারা থাকেন তারাও ঈদ মৌসুমে স্বজনদের কাছে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসে, বিদেশগামী যাত্রীদের মাধ্যমে চিকন সেমাই পাঠানোর অনুরোধ করেন। ঈদের আগে কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা মাধ্যমে চিকন সেমাই পাঠানোর হিড়িক পড়ে যায়। ভর বছর এই চিকন সেমাই মেলে। তবে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যায়। ট্রাকে করে এই সেমাই যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায়। চাহিদার প্রয়োজনে ঈদের প্রায় দুই মাস আগে চিকন সেমাই তৈরির ব্যস্ততা বাড়ে। বগুড়ার প্রায় প্রতিটি এলাকায় ‘সেমাই পল্লী’ গড়ে উঠেছে। শহরতলির সাবগ্রাম, বেজোড়া, শ্যাওলাগাতি, কালিসামাটি, ফুলবাড়ি, ফুলতলা এলাকাগুলোতে শ্রমিকরা সেহরির পর কাজ শুরু করে। একটানা কাজ চলে বিকেল পর্যন্ত। চিকন সেমাই বানাতে ফ্রেশ ময়দা দরকার। সামান্য ভেজাল থাকলে টানা সেমাই ছিঁড়ে যাবে। রং পাল্টাবে। ময়দা ছেনে নেয়ারও কৌশল আছে। শক্ত ও নরম হওয়ার হেরফেরে সেমাইয়ের মানের পরিবর্তন হয়। নারী শ্রমিক বেশি কাজ করে। প্রতিটি ছোট কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ কেজি করে সেমাই উৎপাদিত হয়। প্রতিদিনের উৎপাদন ৬০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন (৬০ থেকে ৮০ হাজার কেজি)। প্রতিকেজি সেমাই খুচরা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। বগুড়ায় এই সময়টায় ঈদের কেনাকাটার পালায় চিকন সেমাই এখনও যুক্ত হয়নি। তবে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো শুরু হয়েছে। যারা রমজানের ইফতারিতে সেমাই রাখছেন তারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ঈদের কেনাকাটার শেষে চিকন সেমাই তালিকার প্রথমে আসবে। রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর আজও অনেকের মুখে সেমাইয়ের ঈদ নামে শোনা যায়।
×