ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাইবার দুনিয়ায় নতুন নিরাপত্তা বলয় সাইবার আর্মি

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২০ এপ্রিল ২০১৯

সাইবার দুনিয়ায় নতুন নিরাপত্তা বলয় সাইবার আর্মি

২০১০ সাল। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ঘোষণা করলেন তার দেশ আশি শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে সক্ষম। তবে তিনি এটাও বলেন তার দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না। কিন্তু এই কথায় ভরসা পায় না পশ্চিমারা। আন্তর্জাতিক চাপ, অবরোধ এবং কূটচাল যখন চলছিল তখন তেল আবিব এবং পেন্টাগন নতুন এক অস্ত্র প্রয়োগের কথাভাবে। পরের বছর জানা গেল অজ্ঞাত এক ভাইরাস হানা দিয়েছে ইরানের নাতানস পরমাণু প্রকল্প কেন্দ্রে। ইন্টারনেট সংযোগ নেই এমন কম্পিউটারকে বোধহয় ভাইরাস আক্রান্ত করতে পারে না। সেবার এই ধারণাই বদলে দেয় স্টাক্সনেট নামের এই ভাইরাস। স্টাক্সনেট ভাইরাসের তাণ্ডবে ধ্বংস হয় ওই কেন্দ্রের কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজ। পিছিয়ে যায় ইরানের অগ্রগতি। ইরান বা পশ্চিমা কোন পক্ষই এই নিয়ে বেশি কথা বলে না। সাইবার যুদ্ধ এখন আর কোন বই বা সিনেমার ফিকশন নয়। বর্তমান শতকের শুরু থেকেই ইন্টারনেট স্পেসে পতিপক্ষের সীমানায় হানা দেয়ার ঘটনা অনেক ঘটছে। নীতিনির্ধারক এবং সমরবিদরা অনুধাবন করতে পারছেন সরাসরি যুদ্ধটা দিন দিন কমে আসবে এবং যুদ্ধ হবে অদৃশ্য মাধ্যমে। পরাশক্তিগুলো কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে হ্যাকার পুষছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো কিভাবে সাইবার বাহিনী দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে এবং প্রতিপক্ষকে জব্দ করছে- দেখে নেয়া যাক এক নজরে। চীন সাইবার দুনিয়ায় চীনের সুখ্যাতির বদলে কুখ্যাতিই বেশি। যুগের পর যুগ ধরে পশ্চিমাদের ডিজাইন করা কোন অস্ত্রের ব্লু পিন্ট হ্যাক করে নিয়ে আসতে যেন চীনের জুড়ি নেই। ধারণা করা হয় আমেরিকার সর্বাধুনিক বিমান এফ-৩৫ এর ডিজাইনও চুরি করেছে চাইনিজরা এবং সেটার আদলেই তাদের দেশে তৈরি হচ্ছে জে ৩১। গুগল, মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের, ভারতের প্রতিরক্ষা খাত, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নথি কোথায় হানা দেয়নি তারা? ইউনিট ৬১৩৯৮ নামের হ্যাকার ইউনিটকে বড় ধরনের হ্যাকিং এবং তথ্য চুরির জন্য দায়ী করা হয়। এছাড়াও নিজে দেশে অকল্পনীয় ইন্টারনেট সেন্সরশিপ এবং সারা বিশ্বে ইন্টারনেটভিত্তিক গুপ্তচরবৃত্তি আছেই। খুব বেশি জানা না গেলেও চীনের Specialized military network warfare forces এই কাজের সমন্বয় করে থাকে। উত্তর কোরিয়া বেপরোয়া দেশটির সাইবার বাহিনীও রীতিমতো বেপরোয়া। কোন রাখঢাক ছাড়াই প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে যায় ব্যুরো ১২১ এবং ইউনিট ১৮০ নামের কিমের হ্যাকার বাহিনী। ২০১৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর হামলা, পরের বছরই সনি হ্যাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি এবং ভয়াবহ ভাইরাস ওয়ানাক্রাইয়ের পেছনে যে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার দল ‘ইউনিট ১৮০’ এর হাত আছে এটা নিশ্চিত। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রতিদিনই উত্তরের হামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দক্ষিণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা সাইবার কম্যান্ডের সার্ভারই হ্যাক হয়েছিল উত্তরের হাতে। অন্তত ৪০০০ হ্যাকার আছে দেশটির। দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়া এবং চীনের হুমকি থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সাইবার ইউনিট গঠন করেছে দক্ষিণ কোরিয়াও। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তত ৪০০ জন হ্যাকার দেশটির জন্য কাজ করেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ভারত ২০১২ সালে বাংলাদেশের হ্যাকারদের সঙ্গে ভারতের হ্যাকারদের সাইবার সংঘাতের স্মৃতি এখনও তরতাজা। তবে ভারতের সব থেকে বড় মাথাব্যথা চীন, পাকিস্তান এবং অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদীরা। বহিঃআগ্রাসন ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুয়া খবর প্রতিরোধ যেন চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাইবার ইউনিটে কাজ করছে শতাধিক বিশেষজ্ঞ এবং দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। ইরান ইরানের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন ইরান বিড়াল থেকে বাঘে পরিণত হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগেই খবর বেরিয়েছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবারের ফোন হ্যাক করেছিল ইরানিরা। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আমেরিকান ড্রোন হ্যাক করে অক্ষত নামিয়ে আনা, সৌদি তেলক্ষেত্রে ভয়াবহ হামলা, তুরস্কের বিদ্যুত গ্রিড বন্ধ করে দেয়া তাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ২০১০ সালে গঠন হওয়া সাইবার ডিফেন্স কমান্ডেই সর্বোচ্চ সাইবার ইউনিট বলে মনে করা হয়। ইসরাইল ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গোপনীয়তা, দুর্ধর্ষতা এবং ক্ষিপ্রতা শত্রুমিত্র উভয়ের কাছে যেন রূপকথার মতো। আর মোসাদের মতোই ক্ষিপ্র তাদের সাইবার সেনারা। সব থেকে অদ্ভুত বিষয় গত দশকের কয়েকটি ভয়াবহ সাইবার হামলার জন্য ইসরাইল দায়ী এটা সবাই জানলেও শক্ত কোন প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া কাজ হাসিল করে নিতে দেশটির জুড়ি নেই। আশপাশের সব রাষ্ট্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর, পাওয়ার গ্রিড, বাধে হয়ত ঘাপটি মেরে বসে আসে তারা। কম্পিউটার যেখানে আছে ইসরাইল সেখানেই হানা দিতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়। ২০১৬ সালে মরক্কোতে হামাসের আল কাসসাম ব্রিগেডের জন্য কাজ করা সামরিক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জাওয়ারিকে গুপ্তহত্যা করে মোসাদ এজেন্টরা, এ সময় আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি হ্যাক করে অচল করে দেয় ইসরাইলি হ্যাকাররা। এছাড়াও ফোনে আঁড়িপাতা বা কম্পিউটারের ফায়ারওয়াল ভেঙ্গে ফেলাকে মামুলি ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছে দেশটি। বেসরকারী কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান নিত্যনতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করছে। রাশিয়া ২০০৭ সালে এস্তোনিয়াতে একজন সোভিয়েত সেনার কবর সরানো নিয়ে চটে যায় রাশিয়া। কয়েক দিন ধরে চলে এস্তোনিয়ার উপর ভয়াবহ সাইবার হামলা। পরের বছর একই ধাঁচে আক্রান্ত হয় জর্জিয়া। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের ১২টি টিভি চ্যানেলের কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেয় রুশ হ্যাকাররা। তবে এযাবতকালে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্যাকিং কাণ্ড হলো মার্কিন নির্বাচনে তাদের হস্তক্ষেপ। সত্যিই রাশিয়া মার্কিন নির্বাচন কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছিল সেটা জানতে হয়ত আর সময় লেগে যাবে। তাছাড়াও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে রীতিমতো দৌড়ের উপর রাখে রাশিয়া। ইউক্রেনের মিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংসের জন্য সরাসরি রাশিয়া দায়ী। সাইবার যুদ্ধে নিয়োজিত সেনাদের ইনফরমেশন ট্রুপস বলে দেশটি। সরকারী হ্যাকার ছাড়াও দেশই বিদেশী ভাড়াতে হ্যাকারের বিশাল বাহিনী আছে তাদের। ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহ ২০১৩ সালে ৬০ জনের একটি জার্মান সাইবার ইউনিটের কথা পথম প্রকাশ পায়। জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা ওই বছরই সাইবার ডিফেন্স স্টেশনের জন্য ১৩০ জন হ্যাকার নিয়োগ দেয়। ২০১৩ সাল থেকে ৪র্থ সামরিক বাহিনী হিসেবে ফ্রান্স সাইবার বাহিনী গড়ে তুলছে। ২৬০০ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিয়মিত এই কাজে নিয়োজিত আছেন। বাড়তি ৪৪০০ জনকেও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তত ৪৪০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করেছে ফ্রান্স। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স কয়েক দশক ধরেই সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি চর্চা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি নিজেদের উপর হুমকি রুখতে নিজেদের সাইবার আর্মির পরিসীমা বড় করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। দেশজুড়ে প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে শীর্ষ হ্যাকারদের খুঁজে বের করে চাকরি দেয়া হচ্ছে। এ রকম ২০০০ তরুণ হ্যাকারকে নিয়োগ দেবে ব্রিটেন। তবে ব্রিটেনের সাইবার নীতি অনেকটাই রক্ষণাত্মক। অন্যদিকে সুইডেন ইউরোপের অন্যতম নিরাপদ সাইবার স্পেসের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠছে। ফোর্বসের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটিতে ম্যালওয়ার সংক্রমণের হার সবচেয়ে কম। যুক্তরাষ্ট্র চীন, রাশিয়া কিংবা ইসরাইলের ভেলকিতে মনে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বর্ণযুগ হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু এমনটা ভাবাই ভুল। ২০১৩ সালের জুন মাস, হুইসেলব্লোয়ার স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের উপর ভিত্তি করে লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক এবং জবাবদিহিতাবিহীন অনলাইন নজরদারি কার্যক্রম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপতে শুরু করে। বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো জানতে পারে প্রত্যেক নাগরিকের ফোনকল, মেইল এমনকি ওয়েবক্যামে ঘাপটি মেরে বসে আছে সিআইএ, এনএসএ’র গোয়েন্দারা। প্রতিদিন কোটি কোটি ফোনকল রেকর্ড করছে আমেরিকা। এমনকি জাপান বা জার্মানির মতো বন্ধু রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানরাও এই আঁড়িপাতা থেকে রক্ষা পাননি। প্রত্যেকটা রাষ্ট্রের পাওয়ার গ্রিডেও এনএসএ’র হাতের মুঠোয়। যে কোন মুহূর্তেই অন্ধকার করে দিতে পারবে গোটা দেশকে। সন্ত্রাসবাদ একটা অজুহাত মাত্র, মূল উদ্দেশ্য নিজেদের সামরিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখা। কয়েকটা গোয়েন্দা সংস্থা, হ্যাকার বাহিনী এবং সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে কাজে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কমান্ড। নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, চীনের লাগামহীন হ্যাকিং এ কিছুটা বিপাকে পড়লেও এখনও শীর্ষেই আছে মার্কিনীরা একটা কম্পিউটার যেখানে আছে সাইবার হামলা হতে পারে সেখানেই। হঠাৎ করে একটা শহর অন্ধকারে ডুবে গেলে বা কোন দেশের সামরিক হার্ডওয়্যার অচল হয়ে গেলে মুহূর্তেই দেশটি প্রস্তরযুগে চলে যাবে। নিরাপত্তা গবেষকরা বার বার আসন্ন বিপদ নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তবে আধিপত্য বিস্তার বা টিকিয়ে রাখতে যেমন পারমাণবিক বোমা তৈরি বন্ধ করা যায়নি, তেমনি বন্ধ করা যাবে না সাইবার আর্মি বা সাইবার অস্ত্র তৈরি। নামে-বেনামে, ঘোষণা দিয়ে বা পর্দার অন্তরালে পরাশক্তিগুলো ঠিকই নিজেদের সাইবার সেনাবাহিনী বড় করে তুলছে। সময় যত গড়াচ্ছে যুদ্ধের সংজ্ঞা তত পরিবর্তন হচ্ছে। আত্মরক্ষার জন্য হলেও তাই আক্রমণ করতে জানা জরুরী!
×