ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

নুসরাত হত্যার তীব্র নিন্দা প্রধানমন্ত্রীর;###;হত্যাকান্ডে জড়িত সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতেই হবে;###;আমরা মেয়েটিকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখজনক মেয়েটি আমাদের ছেড়ে চলে গেল

কাউকে ছাড়ব না ॥ আগুন দিয়ে হত্যা বরদাশত নয়

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

কাউকে ছাড়ব না ॥ আগুন দিয়ে হত্যা বরদাশত নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আগুনে পুড়িয়ে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। তবে যারা বোরকা পরে নুসরাতের শরীরে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেছে, জড়িতদের কাউকে ছাড়ব না। তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, তারা কেউ ছাড় পাবে না। তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে। সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতেই হবে। আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা বরদাশত করা হবে না। শুক্রবার গণভবনে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মেয়েটিকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখজনক মেয়েটি আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তাকে হত্যা করা হয়েছে বোরকা পরে হাত মুখ ঢেকে। ওকে আগুন দেয়া হয়েছে। যারা নুসরাতকে আগুন দিয়ে হত্যা করেছে তারা জঘন্য কাজ করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ধরা হয়েছে। বাকিদেরও ধরা হবে। কেউ ছাড় পাবে না। এদের কঠোর বিচারের আওতায় আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা ঘৃণিত অপরাধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদাররা এভাবে মানুষ হত্যা করেছিল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার সংস্কৃতি পাকিস্তানী ও বিএনপি-জামায়াতের। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। আর ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পথ দেখিয়েছে বিএনপি। তারা ইতিপূর্বে গাড়িতে পেট্রোলবোমা ছুড়ে জীবন্ত মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। যারা এর শিকার হয়েছে তারাই একমাত্র বুঝতে পারেন এর কত যন্ত্রণা। অনেকে পোড়া শরীর নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন। তাদের অনেককেই আমরা সাহায্য সহযোগিতা করছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা মেয়েটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে চেয়েছিলাম। তবে তার শারীরিক অবস্থা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মতো ছিল না। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এখানে চিকিৎসা চলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। মেয়েটিকে হত্যা করা হলো। জড়িতদের কাউকে ছাড়ব না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের পেতেই হবে। বৈঠকের শুরুতেই দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর একদিন পরেই (রবিবার) আমাদের বাংলা নববর্ষ। কাজেই আপনাদের সকলকে এবং আপনাদের মাধ্যমে সমগ্র বাঙালী যারা আমাদের আছেন, সারাদেশে এবং প্রবাসী সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা বাংলা নববর্ষ উৎসাহের সঙ্গে উদ্যাপন করতে থাকি এবং নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। ফলে সকলে খুব একটা আনন্দময় পরিবেশে এই উৎসব পালন করে থাকে। সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসঙ্গে এই উৎসবটা পালন করা হয়। তিনি বলেন, নতুন বছর শুরু। পুরনো বছরের সব মুছে দিয়ে নতুন বছরের নতুন যাত্রা শুরু হবে। আমি আশা করি বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই যাত্রা শুভ হবে এবং বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এই অপ্রতিরোধ গতিটা অব্যাহত হবে। বিশে^ বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ১০-১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার পর জাতির পিতা একটা যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ে তুলে যখন আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন এবং যখন বাংলাদেশ বিধস্ত দেশ হিসেবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশে^র ১২৫ দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ৭ ভাগ আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়। অর্থাৎ মানুষের যখন একটা স্বস্তি ফিরে আসে ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আঘাতটা আসে। তিনি বলেন, ’৭৫-এর হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী এরাই মূলত ক্ষমতায় আসে। যার জন্য দেশের উন্নতি হয় না। আর এটা হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ যারা স্বাধীনতাই চায়নি, তারা কেন দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চাইবে, বাংলাদেশ সফল হোক তারা চাইবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেতৃত্বে আর্থ-সামাজিকভাবে দেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব। বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসের দেশে পরিণত করেছিল। আমরা কঠোর হস্তে তা দমন করে মানুষের ভেতরে শান্তি নিয়ে আসতে পেরেছি। তারপরও আমরা দেখি কতকগুলো দুর্ঘটনা ঘটে, সামাজিক সমস্যাও দেখতে পাই। সবচেয়ে দুভার্গ্য যে নিরীহ মানুষগুলো এর শিকার হন। কয়েকদিন আগে আপনারা দেখেছেন যে, একজন মাদ্রাসার ছাত্রী অধ্যক্ষ দ্বারা নিগৃহীত হয় এবং তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে আহত করা হয়। পরে মেয়েটি মারা যায়। তিনি বলেন, এই যে মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা এর নিন্দা করার ভাষা আমার নেই। আমি চেষ্টা করেছিলাম মেয়েটিকে বাঁচানো যায় কি না? সিঙ্গাপুরে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা, ভিডিও কনফারেন্সিং করা, তাদের প্রয়োজনীয় মতামত নেয়া, তারা যদি একটু আশ^াস দিত, তাকে পাঠাতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। শেখ হাসিনা বলেন, এই যে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, ইতোমধ্যে আমরা অপরাধীদের গ্রেফতার করেছি। আর বোরকা পড়ে, শুধু বোরকায় না, বোরকায় মুখ চোখ নাক ঢেকে হাতের মধ্যে মোজা পড়ে তারপরে তাকে (নুসরাত) আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে। এরা ছাড়া পাবে না। এদের আমরা ছাড়ব না। আমি মনে করি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের পেতে হবে। যাতে এই ধরনের ঘটনা আর কেউ ভবিষ্যতে ঘটানোর সাহস না পায়। সরকার প্রধান বলেন, এই অগ্নিসন্ত্রাসটা সৃষ্টি করল বিএনপি। ২০১৩ সালে নির্বাচন বন্ধ করার নামে তারা এই অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছিল। জানুয়ারি মাসে ইলেকশন হয়ে যায়। অহেতুক তখন দুই মাস মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। আবার ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত করার নামে তারা যে অগ্নিসন্ত্রাসের সৃষ্টি করে, এই দেশে এ ধরনের বীভৎস ঘটনা সেই পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি। একাত্তরে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন তারা বস্তিতে আগুন দিত। বস্তিতে আগুন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চিৎকার করে বের হয়ে আসত, তখন তাদের গুলি করে হত্যা করত। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, দেখলাম বিএনপি জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকরা একটা রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক একটা জোট বানিয়েছে তারা ২০ দলীয় জোট। তার মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল হচ্ছে জামায়াত। বিএনপি-জামায়াত মিলে জীবন্ত মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পোড়াল, বাস, লঞ্চ, ট্রেন সিএনজি প্রাইভেটকারে আগুন দিয়ে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এই পথটা তো বিএনপিই দেখিয়ে গেছে, জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা। আমি আশা করি যে, এর মধ্য দিয়ে একটা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া দরকার। সম্প্রতি কিছু অগ্নি দুর্ঘটনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে আমাদের দেশে আবহাওয়া জলবায়ু সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজাইন করতে হবে, প্ল্যান করা উচিত। আর এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়ব না এটা কেমন ধরনের কথা? তিনি বলেন, কোনকিছু হলেই লোক জড়ো হয়ে যায়। মিডিয়া যত বেশি নিউজ করে তত বেশি জড়ো হয়। অনেকে সেলফিও তোলে। সেলফি তোলার মতো এত রোমাঞ্চকর ঘটনা হচ্ছে না, সেখানে কিন্তু মানুষ মারা যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। যাই হোক আস্তে আস্তে মানুষ শিখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা যে জায়গা ব্যবহার করেন, যেখানে থাকেন অন্তত নিজেরা একটা ব্যবস্থা সবাইকে করতে হবে। যাতে আগুন লাগলে নিজেকে রক্ষা করা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে তো আমরা করছি। এখন ২২তলা পর্যন্ত রেডার ও ক্রেন যেতে পারে। এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারেই করা। আর কেউ করেনি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও করেনি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া কেউ করেনি। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই বৈঠকে বসেছি উপদেষ্টাদের কাছ থেকে কিছু মতামত নেব। তাছাড়া আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করব। এই বিষয়েও আমরা আলোচনা করব। ইতোমধ্যে আমরা একটা জাতীয় কমিটিও করে দিয়েছি এবং সেখানে কিছু সাব-কমিটিও হবে। আমি একটা অফিসও ঠিক করে দিয়েছি সরকারীভাবে। আমাদের ব্যাপক কর্মসূচী বছরব্যাপী হবে। আমাদের দলের পক্ষ থেকেও প্রতিটি ইউনিট, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে কর্মসূচী এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠনসহ আমাদের বিভিন্ন সংগঠনও যার যার কর্মসূচী নিয়ে উদ্যাপন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১২ ভাগে দাঁড়াবে, মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। সরকার যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনাগুলো নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। ২০৪১ সালের মধ্যে এদেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। এর আগে ২০২০ সালে জাতির পিতার জম্নশতবার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে। দেশজুড়ে ব্যাপক কর্মসূচীর মাধ্যমে ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে পালন করা হবে। ইতোমধ্যে জাতীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে কর্মসূচী প্রণয়নে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, এইচ টি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর, এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সৈয়দ রেজাউল রহমান, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর আব্দুল খালেদ, প্রফেসর হামিদা বানু, মোজাফফর হোসেন পল্টু, মুকুল বোস, এ্যাম্বাসেডর জমির, অধ্যাপক ডাঃ রুহুল হক, মকবুল হোসেন, ড. মীর্জা জলিল, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ উপদেষ্টা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
×