ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই ইলিশের

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১২ এপ্রিল ২০১৯

নববর্ষের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই ইলিশের

মনোয়ার হোসেন ॥ সময়ের আয়নায় উঁকি মারছে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৬। বাংলা পঞ্জিকার হিসাবে নতুন বছর মানেই জাতিসত্তার সুন্দরতম প্রকাশের উৎসব পয়লা বোশেখ। গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে আসা উৎসবটি এখন শহুরে জীবনকে ছুঁয়ে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। বৈশাখ যখন দুয়ারে তখন নানাভাবে উঠে আসে রূপালী ইলিশের কথা। সেই সুবাদে বাজারে জাতীয় মাছের দামও দারুণ চড়া। শহরবাসী অনেক নববর্ষের সঙ্গে নিজের অজান্তেই জুড়ে দিয়েছে পান্তা-ইলিশ। পান্তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও ঐতিহ্য অনুসারে ইলিশের সঙ্গে বর্ষবরণের কোন সম্পর্ক নেই। মন্তব্য করেছেন লোকগবেষক থেকে শুরু করে সংস্কৃতিজন ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। জানা যায়, হাল আমলে বৈশাখে তৈরি হওয়া পান্তা-ইলিশ খাওয়া কালচারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতির। ইলিশের যথাযথ উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার স্বার্থেই বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টজনরা। জাটকা সংরক্ষণে মার্চ ও এপ্রিল-এই দুই মাসে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘কোনো জাল ফেলবো না, জাটকা ইলিশ ধরবো না’ প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ। অথচ পহেলা বৈশাখের দিন রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে ধুম পড়ে যায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার। অসচেতনতার কারণে আপন সংস্কৃতির অংশ মনে করে আরোপিত সংস্কৃতির ভ্রান্ত ধারণায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শহুরে মানুষ। চোখে পড়ে বৈশাখে ইলিশে রসনা মেটানোর বাগাড়ম্বর। সেই রসনা মেটানোর ফলশ্রুতিতে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার হুজুগে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সারাবছরের ইলিশ উৎপাদনে। অন্যদিকে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, পয়লা বোশেখ ও আশপাশের সময়ে মূলত ইলিশের বেড়ে ওঠার সময়। এ সময় ইলিশ আসলে জাটকা থাকে, ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। তথাপি নববর্ষ উদ্যাপনের নামে অত্যুৎসাহী প্রবণতায় হিমাগারের স্বাদহীন ইলিশ খাওয়ার ঝোঁকটি দেখা দেয় প্রবল। স্বাদহীনতার পাশাপাশি হিমাগারের ইলিশটি স্বাস্থ্যসম্মতও থাকে না। বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত নববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর খাবার তালিকা থেকে ইলিশ বর্জন করেছেন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের মাধ্যমে নগর জীবনে প্রচলিত হয়েছিল বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের রীতিটি। নববর্ষের পান্তা-ইলিশ প্রথার প্রচলন প্রসঙ্গে ছায়ানটের সভাপতি ও দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সন্্জীদা খাতুনের ভাষ্যটি এরকম- নববর্ষ উদ্্যাপনে পান্তা-ইলিশ খেতে হবে- এমনটা কখনও দেখিনি, শুনিনি। বছরের বাকি দিনগুলোর মতোই নববর্ষে গ্রামের মানুষ পান্তা ভাত খায়। কিন্তু সেখানে ইলিশ থাকে না। কাঁচা লংকার সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে অথবা মরিচ পুড়িয়ে গাঁয়ের মানুষ পান্তা খায়। ইলিশ তো দামি মাছ, এটা গ্রামের মানুষ কোথায় পাবে? এ এক অদ্ভূত জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বর্ষবরণের আয়োজনে। একসময় দেখলাম আমাদের প্রভাতী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের গা ঘেঁষে দর্শকদের ঠেলে কিছু দোকান বসল। সেখানে পান্তা ইলিশ খাওয়ানো হতো। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এসব দোকান দিয়েছিল। আর দোষটা এসে চেপেছিল আমাদের ঘাড়ে। এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ইলিশের সঙ্গে কোনকালেই বাংলা নববর্ষের সম্পর্ক ছিল না। তাই ইলিশ নববর্ষের অনুষঙ্গ নয়। যারা ইলিশকে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ মনে করে তাদের উন্মাদ ভাবা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। পয়লা বোশেখে পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার এই প্রবণতা একইসঙ্গে অনৈতিক ও হুজুগে বলে উল্লেখ করেছেন ইকো মৎস্য প্রকল্পের পরিচালক ও মৎস্যসম্পদ গবেষক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব। তিনি বলেন, মার্চ এপ্রিল এই দুই মাস হচ্ছে জাটকা ইলিশের মৌসুম। এ কারণেই এই দুই মাসে জাটকা ধরা সরকারীভাবে নিষিদ্ধ। এই প্রচার সফল করতে গত বছর ধরে নববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিজ খাবারের তালিকা থেকে ইলিশ বাদ দিয়েছেন। ধীরে মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এ কারণে ২০১৭-১৮ সালে ইলিশের মোট উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৭ লাখ টানে। তাই যদি নববর্ষকে উপলক্ষ করে মানুষের মধ্যে ইলিশ খাওয়ার ধুম ওঠে তাহলে এই জাতীয় মাছটির উৎপাদন ব্যাহত হবে। অন্যদিকে অসময়ে মানুষের এই ইলিশ খাওয়ার প্রবণতায় জেলেরাও জাটকা ধরতে উৎসাহী হচ্ছে। ফলে রূপালী ইলিশের ওপর বিরাট চাপ পড়ছে। আর বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের কোন অতীত ঐতিহ্যও নয়। এটি আমাদের কোন পুরনো রীতিও নয়। একসময় কৃষকরা শুকনো মরিচ চটকে বা কোন ভর্তা দিয়ে পান্তা খেত। সেই থেকে বৈশাখে নাগরিকদের মধ্যে পান্তা খাওয়ার কিছুটা প্রচলন থাকলেও সেই পাতে ইলিশ থাকত না। এখন পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়াটা কিছু মানুষের মধ্যে একটা হুজুগে পরিণত হয়েছে। মূলত বর্ষাকালকে কেন্দ্র করে জুন-জুলাই ও আগস্ট হচ্ছে ভরা ইলিশের মৌসুম। অথচ বৈশাখে মানুষের ইলিশ খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে ব্যবসায়ীরাও কূটকৌশল গ্রহণ করছে। তারা ভরা মৌসুমের ইলিশকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে না দিয়ে কোল্ড স্টোরে গুদামজাত করে। তখন আর ১৬ কোটি মানুষের বছরে অন্তত একদিনের জন্য ইলিশ খাওয়ার সাধটি পূরণ হয় না। গুদামজাত মাছকে চড়া দামে ছাড়া হয় বৈশাখ মাসে। সেসব মাছ কিনতে পারে না নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষ। ইলিশ চলে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই ইলিশের যথাযথ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে মার্চ-এপ্রিলে ইলিশ খাওয়া চলবে না। পয়লা বৈশাখে যদি শহুরে মানুষের মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়ার খুব বেশি শখ হয় সেক্ষেত্রে তারা ভাজা তেলাপিয়া মাছ দিয়েও খেতে পারে। কয়েক বছর ধরে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আমরা কিছুটা সফল হয়েছি। শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সচেতন নাগরিকরা নববর্ষে ইলিশ খাওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এই হুজুগে সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ হবে বলে আমরা আশা করি।
×