ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মা-বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় টেলি সামাদ

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ৮ এপ্রিল ২০১৯

 মা-বাবার কবরের  পাশে চিরনিদ্রায়  টেলি সামাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত জনপ্রিয় অভিনেতা টেলি সামাদ। রবিবার বাদ আছর জানাজা শেষে গুণী এই অভিনেতার ইচ্ছা অনুযায়ী মা-বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সেখান থেকে টেলি সামাদের ছেলে দিগন্ত সামাদ মোবাইল ফোনে জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে সকালে মরহুমের মরদেহ আনা হয় নিজের প্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে। দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা এলেন তাকে শেষ বিদায় জানাতে। এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাবে তার চতুর্থ জানাজায় অংশ নেন তারা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, তথ্য সচিব আবদুল মালেক, সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফারুক, অভিনেতা উজ্জল, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, আলীরাজ, ড্যানি সিডাক, অমিত হাসান, জায়েদ খান, সম্রাট, অভিনেত্রী অঞ্জনা, নাসরিন, জেসমিন, সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফিকুল আলম, ফকির আলমগীর, প্রযোজক নাসির উদ্দিন দিলু, নাদের খান, রশিদুল আমিন হলি, খোরশেদ আলম খসরু, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, মনতাজুর রহমান আকবর, ইস্পাহানী আরিফ জাহান, নোমান রবিন প্রমুখ। জানাজা শেষে ভারি হয়ে উঠে এফডিসি চত্বর। টেলি সামাদকে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চাপা কান্না জমে আছে সবার। আর কখনও দেখা হবে না, আর কখনও হবে না কোন কথা। কোনদিন নতুন কোন কৌতুকে এফডিসি কিংবা সিনেমার পর্দা মাতাবেন না প্রিয় টেলি সামাদ। জানাজার পর তার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ চলচ্চত্র ল্পী স, বাংলাদেশ চলচ্চত্র পস, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। টেলি সামাদের কফিনে ফুলের শ্রদ্ধা শেষে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, টেলি সামাদ চার দশক ধরে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রকে আলোকিত করেছেন। তিআমাদের চলচ্চিত্রের গুণীশিল্পী ছিলেন। তার অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলাম আমরা সবাই। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য বেদনার। তার মতো শিল্পীর মৃত্যুতে চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার আত্মার শান্তি কামনা করি। অনুভূতি জানাতে গিয়ে অশ্রু মুছলেন নায়ক ফারুক। তিনি বলেন, টেলি সামাদের অনেক গুণ। অনেকে হয়তো জানেন না, তিনি স্টেজে ভাল গান গাইতে পারতেন। গান গেয়েও মানুষ হাসাতে পারতেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিল্পী। এমন শিল্পী খুব বেশি জন্মায় না। অভিনেতা আলীরাজ বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অত্যন্ত উঁচু মানের একজন শিল্পী ছিলেন টেলি সামাদ। কমেডিয়ান টেলি ভাই ছিলেন একজন জাতশিল্পী। অভিনয় শিল্পকে ভালবেসেছেন নির্লোভ মনোভাব নিয়ে। যত বড় শিল্পী ছিলেন তার চেয়েও বড় মানুষ ছিলেন তিনি। যতদিন এই দেশে মানুষ টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র দেখে হাসবে-কাঁদবে ততদিন টেলি সামাদকে মনে রাখবেন তারা। আমাদের টিভি ও সিনেমার ইতিহাস কখনই টেলি ভাইকে বাদ দিয়ে পূর্ণ হবে না। এসময় টেলি সামাদের দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান দিগন্ত সামাদ বলেন, আমার বাবা সব সময় চেয়েছেন মানুষকে হাসাতে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কোন কথা বলতেন না। তিনি বলেন, যার বাবা হারায় সেই বুঝে জীবন কত কঠিন হয় তখন। মাথার উপর বাবা ছিলেন বিশাল শক্তি হয়ে। কারণ রাস্তার পাগল থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, সবাই বাবাকে চেনেন ও ভালবাসেন। এমন বাবার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। দীর্ঘদিন তিনি এফডিসিতে এসেছেন, কাজ করেছেন। জেনে বা না জেনে হয়তো কিছু ভুল-ত্রুটি তিনি করেছেন। তার ছেলে হিসেবে তার পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চাই। আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন তিনি যেন বেহেশতবাসী হন। তার বাবার মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন দিগন্ত। এফডিসিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে টেলি সামাদের কন্যা সোহেলি সামাদ কাকলী বলেন, আমরা সব ভাইবোনেরা পথ চেয়ে থাকতাম বাবা কখন বাসায় ফিরবেন। কিন্তু আর কোনদিন বাবার জন্য পথ চেয়ে থাকতে হবে না। ভাবলেই বুক ফেটে যাচ্ছে বাবা আর কোনদিন বাসায় ফিরবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা তিন ভাই বোন। আমার ছোট বোন সায়মা সামাদ। আর আমার বড় ভাই ওসমান সামাদ। তিনি থাকেন আমেরিকাতে। তিন ভাই বোনকে কলিজার টুকরার মতো আগলে রাখতেন বাবা। শিক্ষা দিয়েছেন মানবিকতা, মনুষত্ব ও জীবনের চমৎকার সব দর্শনের। জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এফডিসি থেকে ফ্রিজিং ভ্যানে করে টেলি সামাদের মরদেহ নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার নয়াগাঁও গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাদ আছর তার আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গুণী এই অভিনেতার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক গোরস্তানে তার মা-বাবার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ এপ্রিল শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে মারা যান চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা টেলি সামাদ (৭৪)। খাদ্যনালী, ফুসফুসের সমস্যাসহ একাধিক রোগে ভুগছিলেন তিনি। শনিবার বাদ মাগরিব ধানমন্ডির তাকওয়া মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাদ এশা পশ্চিম রাজারবাজার মসজিদ এবং রাত সাড়ে দশটায় মগবাজারের দিলু রোডে তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন হয়। এদিন রাতে টেলি সামাদের মরদেহ ছিল লাশবাহী গাড়িতে তার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায়। আজীবন অভিনয় দিয়ে মানুষকে হাসিয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন গান গেয়েও। সেই হাসির নায়ক টেলি সামাদ শেষ বিদায় নিলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। তিনি ১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আবদুস সামাদ হলেও অভিনয় জগতে এসে হয়ে যান টেলি সামাদ। তিনি পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায়। সঙ্গীতেও এই গুণী অভিনেতার ছিল পারদর্শিতা। অভিনয়ের বাইরে ৫০-এর বেশি চলচ্চিত্রে তিনি গানও গেয়েছেন। ‘মনা পাগলা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। নজরুল ইসলামের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের দিকে ‘কার বৌ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে এই অঙ্গনে পা রাখেন তিনি। তবে দর্শকের কাছে যে ছবিটির মাধ্যমে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সেটি হলো ‘পায়ে চলার পথ’। অভিনয় করেছেন প্রায় ছয়শ চলচ্চিত্রে। যদিও এই অভিনেতার আজীবন আক্ষেপ ছিল, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাওয়ার কারণে। ২০১৫ সালে টেলি সামাদ অভিনীত সর্বশেষ ছবি মুক্তি পায় অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রী’। তার অভিনীত জনপ্রিয় সিনেমা হচ্ছে-জিরো ডিগ্রী (২০১৫), কুমারী মা (২০১৩), সাথী হারা নাগিন (২০১১), মায়ের চোখ (২০১০), আমার স্বপ্ন আমার সংসার (২০১০), রিকসাওয়ালার ছেলে (২০১০), মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯), কাজের মানুষ (২০০৯), মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি (২০০৯), কে আমি (২০০৯) , কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩), মিস লোলিতা (১৯৮৫), নতুন বউ (১৯৮৩), মাটির ঘর (১৯৭৯), নাগরদোলা (১৯৭৯), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), জয় পরাজয় (১৯৭৬), গুন্ডা (১৯৭৬), সুজন সখী (১৯৭৫), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), রঙিন রূপবান, ভাত দে।
×