ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃতী কবি নাসিমা সুলতানা

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ৫ এপ্রিল ২০১৯

কৃতী কবি নাসিমা সুলতানা

দক্ষতা ও মেধা নিয়েও বরাবর পুরুষের চেয়ে নারী পিছিয়ে পড়ে লিঙ্গবৈষম্য কিংবা পুরুষতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিকতার মন্ত্রে আবার মুগ্ধ মানুষেরাও আজকাল নারী ও তার প্রতিভাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আড়াল ও বিভাজন করে রেখেছে। সাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরুষেরা সাহিত্য চর্চা করলে কবি, সাহিত্যিক অভিধা পায় কিন্তু নারী চর্চা করলে তাকে নামের আগে নারী কথাটি বসিয়ে দেয়া হয়। নারী লেখকদের কাতারে ফেলে পৃথক করে রাখা হয়। তেমনি আশির দশকের প্রতিভাময়ী, সাহসী ও প্রগতিশীল লেখক, কবি নাসিমা সুলতানা এমনি করে আড়াল এবং পৃথক হয়ে গেছেন। যদি খেয়াল করে দেখা যায়- কী বিশ্বসাহিত্য, কী বাংলা সাহিত্য, সবখানে এই দৈন্য পরিষ্কার। পৃথকীকরণের এই ছক একবার পাঠ করে নেয়া দরকার। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। তাঁর ময়মনসিংহ গীতিকা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। নিজের জীবনের ওপর রচিত এ লোকগাথা কাব্য আজ বৃহত্তর লোকগোষ্ঠীর পাঠ ও আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই মধ্যযুগের নারী কবি চন্দ্রাবতী থেকে শুরু করে উনিশ শতকের আধুনিক যুগের প্রাক্কালে স্বর্ণকুমারী দেবী, নওয়াব ফয়জুন্নেসা, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, শামসুন নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম, সেলিনা হোসেন, নুরজাহান বেগম, মহাশ্বেতা দেবী থেকে শুরু করে আশির দশকের অন্যতম শক্তিশালী ও মেধাবী কবি নাসিমা সুলতানা অন্যতম। এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কবি হলেন- প্রথম থেকে চন্দ্রাবতী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, কামিনী রায়, বেগম সুফিয়া কামাল। আশির দশকের যে ক’জন কবির নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তার মধ্যে রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবু হাসান শাহরিয়ার পাশাপাশি নাসিমা সুলতানার নামও জোরেশোরে শোনা গেলেও প্রচার দুনিয়ায় তিনি একেবারেই অর্বাচীন। আশির দশকের অন্যতম সাহসী কবি নাসিমা সুলতানা মিতু জন্মগ্রহণ করেন কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায় ১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। আর ১৯৯৭ সালের ১৭ নবেম্বর বিরলপ্রজ এই কবি প্রেমের পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর নাসিমা সুলতানা কবি ও গল্পকার। সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুটি মৃগয়ায় যুদ্ধের ঘোড়া এবং তবু কেউ কারও নই। এছাড়া কবি সাইফুল্লআহ মাহমুদ দুলালের সঙ্গে ভাগাভাগিতে আরেকখানা কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। ছড়াকার হাসনাত আমজাদ বলেন, কুষ্টিয়ার মেয়ে নাসিমা সুলতানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খুব কাছে থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, একসঙ্গে অনেক বিকেল কাটিয়েছি আমরা কয়েকজন। আমি, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, মনিরা কায়েস আর নাসিমা সুলতানা। শাহরিয়ার আর ফারুক যদিও ঢাকায় থাকতো, তবুও রাজশাহীতে যেত তারা প্রাণের টানে, লেখালেখির টানে, আড্ডার টানে। মনিরা কায়েস বলত, নাসিমা সুলতানা সে আমার সিলভিয়া প্লাথ, আমার প্রিয় কবি। নাসিমা সুলতানা আজ নেই- মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের সকলের কাছ থেকে...! ৮০-এর দশকে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে হাসনাত আমজাদ সম্পাদিত ছোট কাগজ ‘এখনে’ আমরা’য় প্রকাশিত হয় নাসিমা সুলতানার কবিতা দই চোখে মানুষ দেখে কিন্তু কবির চোখ ত্রিনয়নী, সে পরিষ্কার আগে-পিছে, বর্তমান দেখতে পায় আর এই দেখার মধ্যে স্বচ্ছ-স্ফটিক সত্যকে দেখে অথচ এই সত্য সবসময় আড়াল হয়ে শাসিতের সিংহাসন রক্ষা করে চলেছে নিরন্তর। কী বাদশাহী আমল, স্বৈরাচারী বা গণতান্ত্রিক কাল, চিরটাকাল শোষণের ব্যঞ্জনধ্বনিই বাজে যার স্বর ও সুর একজন কবিকে আক্রান্ত করে দ্রোহী শব্দ উচ্চারণ করতে। নাসিমা সুলতানার মননে, চৈতন্যে সেই সময়ের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল বলেই তিনি লিখেছেন- প্রকৃতির সেতারে বাজে ভৈরবী, ইমন কল্যাণ ভাদ্রের নদীতে বাড়ে জল আর আমাকে পোড়ায় এক চিরজীবী আগুন শরীর আমার হৃদয় আমার ভেসে যায় সেই অগ্নিপ্রপাতে আহ্ কী প্রগাঢ় ফেনিল দীপ্র আতপ্ত বাসনা! যেন মৃত্যুর পরেও সে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে হাজার বছর। নাসিমা সুলতানার মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমি থেকে সেলিনা হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাঁর জীবনী লেখার জন্য কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কাজটি সিংহভাগ শেষ হয়ে এসেছে। নাসিমা সুলতানার স্বামী আহসানুল হাকিম টুটুল তার ‘ঋত্বিক’ প্রকাশনী থেকে ‘নাসিমা সুলতানা সমগ্র বের করেছেন। আহসানুল হক টুটুল গত হলে তার প্রকাশনীটিও অতীত হয়ে গেছে। অসম্ভব মেধাবী কবি নাসিমা সুলতানার কবিতার সঙ্গে বর্তমান সময় খুব একটা পরিচিত নয় অথচ তার কবিতার প্রকরণ, শৈলী, বিষয়বস্তু- প্রাগমেটিভ, সর্বদা বিবেককে জাগ্রত করায়, এক অন্যন্য উপলব্ধির খোঁজ করায়। কবিতাপ্রিয় মানুষ নাসিমা সুলতানার কবিতা পাঠ করলে নিশ্চয় তার রসবোধে আক্রান্ত হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। ‘বহুকাল অন্নহীন বস্ত্রহীন’ ও চিরজীবী আগুন’ আশি এবং নব্বই দশকের সমাজ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি যা এখনকার অনেক ব্যবস্থা এবং বাস্তবতার সঙ্গেও সাযুজ্য। সমকাল স্বসময়ের উপলব্ধির খোঁজ করে না, এই খোঁজটা অন্যকালের, অন্য সময়ের দায় বলে সে শুধু সাক্ষী সমকালের।
×