ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

অপরিকল্পিত নগরী বগুড়া অগ্নিঝুঁকিতে

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৩১ মার্চ ২০১৯

অপরিকল্পিত নগরী বগুড়া অগ্নিঝুঁকিতে

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ বহুতল ভবনে গড়ে ওঠা বগুড়া নগরীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের দ্রুত নিয়ন্ত্রণে কোন পানির আধার নেই। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী শুকনো। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। যে দুটি পুকুর কোন রকমে টিকে ছিল তাও ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলছে। কথা হয়েছিল বগুড়ার অন্তত ৫টি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্ট (রাস্তার ধারে ভূগর্ভস্থ জলাধার, যেখানে ফায়ার সার্ভিস পাইপ লাগিয়ে আগুন নেভাতে পারে) নির্মাণ করা হবে। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, বড় মার্কেটের মালিকদের এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। আজও ওয়াটার হাইড্রেন্ট নির্মাণ করা হয়নি। নবাববাড়ি সড়কের ধারে অত্যাধুনিক বহুতল মার্কেটে কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে জলাধার নির্মাণ করেছে। বগুড়া ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার বজলুর রশিদ জানান, অপরিকল্পিতভাবে বগুড়া নগরী গড়ে উঠছে। বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি ভবনে। নিয়ম আছে ৭ তলা ভবনের ওপর কোন অবকাঠামো স্থাপনা (বাড়িঘর, মার্কেট, অন্য স্থাপনা) নির্মাণ এবং কোন পুকুর ভরাট করতে হলে ফায়ার সার্ভিসেরও ছাড়পত্র লাগবে। কেউ নেয়নি। বগুড়ায় গত দুই যুগে এক শ’টিরও বেশি পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। জামিলনগর এলাকার বড় একটি পুকুর, রেলস্টেশনের পশ্চিমে রেল কর্তৃপক্ষের প্রাচীন জোড়া পুকুর (দুটি পুকুর একসঙ্গে) অবৈধ দখল করে অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি শেষ হওয়ার পর উন্মুক্ত কোন উৎস থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। বড় অগ্নিকা-ে উপজেলা পর্যায়ের ও কাছাকাছি জেলাগুলোর ফায়ার সার্ভিসকে ডেকে আনতে হয়। এতেও কালক্ষেপণ হয়। অগ্নিকা-ে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। বগুড়া নগরীতে প্রধান সড়ক ছাড়াও সরু ফিডার রোডগুলোতে যেভাবে বেশি তলার ভবন নির্মিত হচ্ছে তাতে অগ্নিকা-ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ওই সড়কে প্রবেশ করতে পারে না। অগ্নিনির্বাপণে বগুড়া ফায়ার সার্ভিসে যে যানবাহন ও সুযোগ-সুবিধা আছে তাতে ২০ তলা ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে যা আছে তা দিয়ে বহুতল ভবনে (২০ তলার নিচে) আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রায় দশ বছর আগে নগরীর বাণিজ্যিক এলাকায় অন্তত দশটি ওয়াটার হাইড্রেন্ট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। আধুনিক মার্কেট, বহুতল ভবনগুলোতে নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য ভূগর্ভে অথবা উপরিভাগে অন্তত এক শ’ বর্গফুট করে জলাধার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাব ও সুপারিশ জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় অনেকবার উত্থাপিত এবং আলোচনা হয়েছে। আজও কেউ উদ্যোগ নিয়ে এমন জলাধার নির্মাণ করেনি। জেলা সমন্বয় কমিটির সর্বশেষ সভায় বগুড়া ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার বজলুর রহমান বগুড়ার অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে ওয়াটার হাইড্রেন্ট নির্মাণের প্রস্তাব দেন। পুকুর ভরাট, সাততলা ভবনের ওপরে অবকাঠামো নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেয়ার সুপারিশ করেন। কোনটিই কার্যকর হয়নি। বজলুর রহমান জানান, বগুড়ার বহুতল ভবনগুলোর কি অবস্থায় আছে, মার্কেটগুলো এবং বড় বিপণিবিতান, শোরুম, হোটেল, চায়নিজ রেস্তরাঁ ও উন্নতমানের হোটেলগুলোতে ফায়ার এক্সটিংগুইসার আছে কিনা এবং অগ্নিকা-ের উৎসগুলোতে কোন সাবধানতা নেয়া আছে কিনা এসব বিষয় নিরূপণ করে সাতদিনের মধ্যে প্রশাসনকে জানানো হবে। বগুড়া নগরীর একেবারে ভেতর দিয়ে রেললাইন থাকায় উত্তর ও দক্ষিণাংশ খ-িত হয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিস নগরীর দক্ষিণাংশে। উত্তরাংশে আগুন লাগলে রেলগেট বন্ধ থাকলে দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হয় না। তবে বগুড়ার উত্তরাংশের মাটিডালিতে ফায়ার স্টেশন নির্মাণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দক্ষিণাংশের শাজাহানপুর, দক্ষিণ-পশ্চিমের আদমদীঘি ও ঘোড়াধাপেও ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, গত নয় বছরে বগুড়ায় প্রায় দেড় হাজার অগ্নিকা-ে এক শ’ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। বগুড়া নগরীর পৌর এলাকা সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানে প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার। দ্রুত নগরায়ণের পালায় পৌর এলাকা ঘিঞ্জি হয়ে পড়ছে। একে তো অপরিকল্পিত নগরী তারপরও যে যার ইচ্ছামতো ভবন নির্মাণ করে অগ্নিঝুঁকির পাশাপাশি ভূমিকম্প ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলেছে। ফিডাররোডগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিকমতো পৌঁছতে না পারলে দূর থেকে পাইপ টেনে পানি আগুন নিয়ন্ত্রণও কঠিন। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির যে বিশেষায়িত মই থাকে তা গাড়ি ঢুকতে না পারলে ওপরে উঠে দ্রুত জানমাল রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। খোঁজখবর করে জানা যায়, মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী ও বহুতল ভবনের মালিকরা অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় জলাধার নির্মাণের বিষয়ে একমত। তবে মার্কেটের দোকানি ও ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে এই ওয়াটার হাইড্রেন্ট নির্মাণে রাজি নয়। তারা চায় মালিক নির্মাণ করুক। মালিক নীরব। সাধারণের কথা- আগুন লাগলে তার প্রভাব আশপাশে পড়বেই। সকলেই বিষয়টি জানেন বোঝেন কেউ এগিয়ে আসেন না।
×