ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৯ মার্চ ২০১৯

  অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন এক সময় বিশ্ব রাজনীতিতেও বিশাল প্রভাব ফেলে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো নিজ নিজ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনার মূল্যায়ন করতে থাকে। তাদের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয় ঘটনার গুরুত্বানুসারে। এর মধ্যেই অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে। কেউ কেউ আবার নীতিগত সমর্থন জানায়। যুদ্ধের মাঠ ও মাঠের বাইরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। রেডিওতে ঘোষণা করা হলো আটটা-পাঁচটা কারফিউ থাকবে না। বিকেল ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সমাবেশের কাজ সম্পন্ন হয়। ব্যাটালিয়নের অফিসার এবং সৈনিকদের টাউন হলে একত্র করে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। পাকিস্তানী বাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে এসে মেডিক্যাল কলেজ ও নিকটবর্তী পাহাড়ের ওপর সমবেত হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানীরা প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর রাতে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে তাঁকে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১১টায় জগদীশপুরের মহড়া থেকে প্রথম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যশোর ইউনিটে ফিরে আসে এবং গোলাবারুদ অস্ত্রাগারে ফেরত দেয়। ক্যাপ্টেন রশীদের সফল অভিযানে ২৫তম পাঞ্জাবের মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইশফাকসহ ৪০ জন পাকিস্তানী সৈন্য পাবনা থেকে গোপালপুরের পথে নিহত হয়। জীবিতদের অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে রাজশাহীর দিকে যাওয়ার পথে প্রাণ হারায়। রাতে ১০০ জনের মতো বাঙালী ইপিআরকে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে রমনা কালীবাড়ির কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই দিনে নিখোঁজ হয়েছেন পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতির দাবি উত্থাপনকারী বরেণ্য রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ’৭১-এর রক্তগঙ্গার অন্যতম শিকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই দিন কুমিল্লা শহরে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। সকালে ময়মনসিংহের রাবেয়া মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে ইপিআর বাহিনী ও হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। নির্ভীক সৈনিক সিপাহী লুৎফর রহমান লালমনিরহাট শহরের কাছে অবাঙালী ও বাঙালী ইপিআরদের সংঘর্ষে শহীদ হন। ইপিআর সিপাহী আবদুল হালিম ১২ নম্বর উইংয়ের সুনামগঞ্জ কোম্পানি হেডকোয়ার্টারসে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শহীদ হন। রংপুর জেলার সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈনিকরা বিদ্রোহ করার সময় প্রচ- ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যশোর সেনানিবাসে প্রথম ইস্টবেঙ্গল তৎকালীন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নরা বিদ্রোহ করে এবং পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে যুদ্ধ করতে করতেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়। একাত্তরের মার্চে যখন বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো, পাকিস্তানের সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরোর সঙ্গে ফ্রান্সের তুলঁ সাবমেরিন ইয়ার্ডে প্রশিক্ষণরত ১৩ জন বাঙালী সাবমেরিনারের মধ্যে ওয়াহেদ চৌধুরীসহ আটজন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ওই ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যান। নানা রকম আইনী প্রক্রিয়া শেষে কয়েকটি দেশ ঘুরে ১০ দিন পর দিল্লীতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। পরে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের নেতৃত্বেই ৩০০ জনের নৌ কমান্ডো দল গড়ে তোলা হয়। এইদিনে হাউস অব কমন্স সভায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সচিব স্যার এ্যালেস ডগলাস হিউম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালীদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোয় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তানকে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া ওই দিন হাউস অব কমন্স সভার আলোচনায় তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের নিরাপত্তার কথাও উত্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
×