ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী অর্থবছরে বাজেট ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৯ মার্চ ২০১৯

আগামী অর্থবছরে বাজেট ৫ লাখ  ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা

এম শাহজাহান ॥ স্বাধীনতার ৪৮ চল্লিশ বছরে জাতীয় বাজেটের আকার বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ৬৭০ গুণ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে আগামী অর্থবছরের নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে এই বাজেট ৭ লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই সময়ের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তার ওপর নির্ভর না করে ধীরে ধীরে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট প্রণয়নের কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য আয়কর ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা করবেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী ‘গ্রাম হবে শহর’ এই দর্শন সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এজন্য গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে। একজন মানুষ গ্রামে বাস করেও যাতে শহরের নাগরিক সুবিধা পেতে পারেন সেভাবে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় গ্রামীণ কর্মসূচীমুখী প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরা হচ্ছে ২৮ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটের তুলনায় ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হয় ২৫ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তিনি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জিডিপির সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেন, যা চলতি বছরের জুলাইয়ে শেষ হবে। গত অর্থবছরে কৃষি খাতের ওপর নির্ভর করে বিশেষ করে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে উঠেছিল। এদিকে পদ্মা সেতুর মতো অন্য মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে নতুন বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মূল লক্ষ্যÑউচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, যা ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারে চলমান উন্নয়ন কর্মকা- দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার ভিশন রয়েছে। উৎপাদন ও সেবা খাত চাঙ্গা হওয়ায় জিডিপির আকার বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা হয়েছে সেবা খাত। শিল্প খাতে কিছুটা মন্দা গেলেও কৃষি খাতে বাম্পার ফলন হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এসব কারণে জিডিপির আকার বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আরও বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। জিডিপি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেন, জিডিপি হিসাবের জন্য ১৫টি কম্পোনেন্টের মধ্যে প্রায় সবই উর্ধমুখী ছিল। বিশেষ করে রফতানি খাত, বিনিয়োগ, উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধি ভাল ছিল। প্রবৃদ্ধির যে গতি অর্জন হচ্ছে তাতে ২০২০ সালের পরের ৩ বছরে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন করা অসম্ভব নয়। এদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচী সামনে রেখে নতুন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। গত ১০ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়ানো হবে। বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা এ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেট ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এডিপির আকার প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতের মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদ্যুত, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ, বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী, সরকারী সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন, বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার, প্রবাস আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রফতানি বাজার অনুসন্ধান করা। জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। পদ্মা সেতুসেহ দশ মেগা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগের দশ প্রকল্প এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দ্রুত বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন শাখা হতে এ ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আজিজুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারকে মূলস্তম্ভ হিসেবে সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটা সরকারের নির্দেশনাও। এছাড়া সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে আমার গ্রাম আমার শহর দর্শন সামনে রাখা হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দর্শন সামনে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে আগামী বাজেটে দশটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান, বিদ্যুত ও জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও আইসিটি খাত উন্নয়ন, বৃহৎ প্রকল্প (মেগাপ্রজেক্ট) বাস্তবায়ন, ব্লু-ইকনোমি-সমুদ্র সম্পদভিত্তিক উন্নয়ন, বেসরকারী খাত ও বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ ও গণমুখী দক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিত করা। এর ফলে সর্বস্তরে উন্নয়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলটির সর্বশেষ সম্মেলনের ঘোষণা পত্রেও বলা হয়- দেশের সব উন্নয়ন হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অগ্রগতি অব্যাহত রাখা হবে। আমার গ্রাম আমার শহর ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো আগামী বাজেটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়ের নাম হচ্ছে আমার গ্রাম আমার শহর। আমার গ্রাম আমার শহর কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের গ্রাম উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এজন্য কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ, গ্রামের স্কুল কলেজগুলো আধুনিকায়ন ও শিক্ষারমান উন্নয়ন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কৃষি ভর্তুকি বাড়ানো ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করা, ব্যাংকের শাখা বাধ্যতামূলকভাবে গ্রামে চালুকরণ, সহজশর্তে ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণপ্রাপ্তি, ঘরে ঘরে বিদ্যুত সংযোগ, স্বল্প খরচে ডিস ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, এলপি গ্যাস সহজলভ্য করা, ভূমিহীনকে খাসজমি বরাদ্দ, গৃহহীনকে ঘর প্রদান, আধুনিক বাজার ব্যবস্থা চালুকরণ, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়িয়ে দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে দূরীকরণ এবং লাঙ্গল যার জমি তার, জাল যার জল তার নীতি চালুকরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে প্রতিটি গ্রামে। এই দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর করা সম্ভব। এর ফলে দেশের ৮৭ হাজার গ্রামে শহরের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমার গ্রাম আমার শহর এটি একটি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দর্শন। এর ফলে কাঁচা রাস্তা পাকা হবে, থাকবে বিদ্যুত ও ইন্টারনেট সুবিধা। এই দর্শনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে। তিনি বলেন, শহরের মতো গ্রামের মানুষ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, এটি একটি প্রশংসীয় ও ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ।
×