ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

চা শিল্পে নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১১:৫২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চা শিল্পে নতুন সম্ভাবনা

আমরা সবাই জানি- পানির পর চা হলো বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। প্রতিদিন সারা বিশ্বে গড়ে দুই বিলিয়ন কাপ চা পান করা হয়। বাংলাদেশে চা উৎপাদনের বিপরীতে ভোগ বৃদ্ধির হার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি। জানা যায় দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমন প্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থনীতিতে শ্রমনিবিড় চা শিল্পখাতটি ব্যাপক অবদান রাখবে এমনটি প্রত্যাশা শিল্পোদ্যোক্তাদের। এই আশা জাগার কারণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ও দাম দুইই বেড়ে চলেছে। দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে চায়ের আবাদ। এমনকি চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের পাহাড়-টিলাভূমিতেও চা চাষের সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। বড় কথা হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চা আবাদ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। বাংলাদেশ চা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, পরিমিত হারে বৃষ্টিপাত, উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক পদক্ষেপ, নতুন নতুন চা আবাদের এলাকা সম্প্রসারণ, উন্নততর ক্লোন চায়ের চারা লাগানোর হার বৃদ্ধি, সীমিত আকারে হলেও শ্রমিকদের প্রণোদনা প্রদানের ফলে চা উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। আশার খবরটি হলো গত ১০ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চায়ের বাড়তি আবাদ ও উৎপাদন করা হয়েছে। সেখানে উন্নততর ক্লোন জাতের চায়ের চারাগাছ লাগানো হয়েছে, ফলনও দিচ্ছে ভাল। আরও আশার খবর চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের চেষ্টায় বর্তমানে চায়ের ১৮টি উচ্চফলনশীল কোন, চারটি বায়োকোনাল ও একটি পলিকোনাল বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে; যা অধিক চা উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। পঞ্চগড় জেলাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে যেখানে তামাকের চাষ হতো সেসব এলাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চায়ের আবাদ বি¯ৃÍত হচ্ছে। চায়ের আবাদ বিস্তৃতির ফলে চা শিল্প বিকাশে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। নতুন নতুন এলাকায় গড়ে উঠছে চা বাগান। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত চা দু’দশক আগেও বিশ্বের ২০-২২টি দেশে রফতানি করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি চা রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫। দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড চা উৎপাদনে আবারও ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। চা চাষের ইতিহাসে এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার চাশিল্পের জন্য সুখবরই বটে। সদ্য সমাফত চা উৎপাদন মৌসুমে (২০১৮) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। সদ্য সমাফত বছরে সারা দেশের ১৬৬টি বাগানের চা উৎপাদনের হিসাব চূড়ান্ত করেছে চা বোর্ড। তাতে দেখা যায়, গত বছর চা উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি। চা বোর্ড সূত্র জানায়, আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবার চা শিল্পের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর সমাফত চা উৎপাদন মৌসুমে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৮২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি। এর আগে ২০১৬ সালে সব রেকর্ড ভেঙে দেশের চা শিল্পের ১৬২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়েছিল ৮৫ দশমিক ০৫ মিলিয়ন কেজি। চা উৎপাদনে বিশ্বে নবম বাংলাদেশ লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম। সংস্থাটির হিসাবে চা উৎপাদনে এখন শীর্ষে রয়েছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। উৎপাদনে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের নিচে আছে জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো। এর আগে একটানা কয়েক বছর ধরেই দশম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর তারও আগে গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম, ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম। চা উৎপাদন ও রফতানিতে একসময় সারা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ছিল বাংলাদেশের নামটি। দেশে চা পান করার ব্যাপকতা দ্রুত বাড়লেও উৎপাদনের গতি বাড়েনি। আশার কথা হলো- গত দুই বছরে চা উৎপাদনে বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এক বছরের ব্যবধানে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি। বাড়ছে চা শিল্পের আওতা চা চাষের আওতা ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ডের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চা উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে। এসব বিষয়ে চা বোর্ড থেকে তদারকি করা হচ্ছে। আশার খবর, এখন সমতল ভূমিতে চা চাষ হচ্ছে। চা চাষের নতুন এলাকা উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৭ সালে উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫৪ লাখ কেজি। গত বছর উৎপাদন ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ কেজি। বান্দরবানের রুমায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই শিল্পে নতুন সম্ভাবনায় বাগানমালিকেরাও পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা আবাদ করছেন। পরিত্যক্ত জমিতেও চা চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। পরিত্যক্ত থাকা ভূমি চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালিতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা উৎপাদনে আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেছে। হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ উৎপাদনের জন্য জাতীয় পদক পাওয়া হালদা ভ্যালিতে গত বছরও উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৯ লাখ কেজি। চীনে গ্রিন টি রফতানির পাশাপাশি দেশে ‘ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি’ নামে ব্র্যান্ডিংও করছে পেডরোলো গ্রুপের এই কোম্পানি। বাংলার চায়ের সৌরভ ছড়াচ্ছে বিশ্বে চা এক সময়ে রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চায়ের হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। কেননা চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ও রফতানি পণ্য। বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রং, ঘ্রাণ ও স্বাদ- এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর ৫০ লাখ কেজি চা রফতানি হয়। আধুনিক প্রযুক্তির সমাহারে ভারত, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা চা শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে চা উৎপাদনে ১১তম এবং চা রফতানিতে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে। আগে বিশ্বের চা রফতানির এক দশমিক ৭৪ ভাগ চায়ের জোগান দেয়া হতো বাংলাদেশ থেকে। এখন বিশ্বের ২৫টি দেশে চা রফতানি করা হয়। আর বিশ্বের ১৭টি চা রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ নম্বরে। মহাপরিকল্পনা-২০২৫ দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২৫’-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বৃহদায়তনের বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের আবাদ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। দেশের সাতটি জেলায় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চা আবাদের লক্ষ্য হাতে নেয়া হয়েছে। এখানকার আরও ৪ হাজার ৬৯৮ হেক্টর অনাবাদি জমিতে আরও ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব। চা উৎপাদন এবং রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের রূপকল্প-২০২১ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ড ৯৬ হাজার ৭৩৫ দশমিক ৭০ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ১২ বছর মেয়াদী একটি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সরকারের নীতি এবং ভিশন-২০২১-কে সামনে রেখে পরিকল্পনাটি তিন পর্যায়ে ১০টি প্রকল্প প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশের চা শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে ‘উন্নয়নের পথ নক্শা বাংলাদেশ চা শিল্প’ নামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চা বোর্ড। ২০২৫ সালে দেশে চা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ১৪০ মিলিয়ন কেজি। চা বোর্ডের তথ্যে জানা যায়, প্রকল্পটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করেছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, বাগান সম্প্রসারণ, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, গভীর ও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন, বাগান এলাকায় কূপ খনন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ ও সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের চা চারা রোপণ করা হবে। ১০ হাজার হেক্টরে চা বাগান সম্প্রসারণ করা হবে। ১৫ হাজার চা শ্রমিকের গৃহ নির্মাণ ও ১৫ হাজার টয়লেট নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প এলাকায় ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন, ৫০টি কালভার্ট ও ৪টি সেতু নির্মাণ করা হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘মাদার ক্লাব’ করা হবে। চায়ের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১১৫৬২৯.৭৬ হেক্টর থেকে বর্ধিত করারও প্রচেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে চা শিল্প উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চা শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর চা রফতানি করা সম্ভব হবে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে সরকার চা উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এসব সহযোগিতা ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুত সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরও সুবিধা বাড়ানো ও জমি ইজারা নিয়ে বিরোধগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। চা শিল্প শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কর্মসূচী নিতে হবে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নত মানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে।
×