ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সহায়তা পেতে নিউইয়র্ক ফেডের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তি

রিজার্ভ চুরির মামলা ॥ অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রিজার্ভ চুরির মামলা ॥ অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির আট কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বৃহস্পতিবার মামলা করেছে বাংলাদেশ। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ এই অর্থ চুরির সঙ্গে ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত। তিন বছর আগে গত ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হ্যাকাররা হাতিয়ে নেয়। চুরি যাওয়া ওই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে ২ কোটি ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। আর ফিলিপিন্সে চলে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের সিংহভাগেরই কোন হদিস মিলছে না। এদিকে এ মামলায় সহায়তা দিতে নিউইয়র্ক ফেড বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় করা অপর একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। রিজার্ভ চুরিসহ অর্থ পাচারের আট দফা অভিযোগে ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের আরসিবিসির সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত। প্রতিটি অভিযোগের জন্য মায়ার চার থেকে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এই চুরিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনা বলে মনে করা হয়। এ চুরিতে প্রথম সাজা পেলেন মায়া। কারাদন্ডের পাশাপাশি মায়াকে ১০৩ মিলিয়ন ডলারের অর্থদন্ড দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (নিউইয়র্ক ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। এদিকে ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে করা মামলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগে আরও বলা হয়, আরসিবিসির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা এই অর্থ চুরির জন্য কয়েক বছর ধরে বড় ধরনের ও জটিল ষড়যন্ত্র করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা এই চুরিতে সহায়তা করেছে। অর্থ চুরির পর তা নিউইয়র্ক সিটি ও ফিলিপিন্সে আরসিবিসির এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। পরে এই অর্থের বেশির ভাগ ফিলিপিন্সের ক্যাসিনোর মাধ্যমে পাচার করে দেয়া হয়েছে। মামলা করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বলেন, এই মামলায় সহায়তা দিতে নিউইয়র্ক ফেড বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ফেড রিজার্ভ চুরির অর্থ আদায়ে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মামলার মাধ্যমে রিজার্ভ চুরির টাকা উদ্ধারসহ দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে এটাই বাংলাদেশের প্রত্যাশা। সূত্রমতে, হ্যাকাররা প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরি করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তবে তারা ১০ কোটি ১০ ডলার চুরি করতে পারে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কার একটি এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে বানান ভুলের কারণে শ্রীলঙ্কার এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা অর্থ ফেরত আসে। ২০১৬ সালের আগস্টে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরির অর্থ স্থানান্তর বন্ধে ব্যর্থতার কারণে আরসিবিসি ব্যাংককে রেকর্ড পরিমাণ ১৯ মিলিয়ন ডলার বা ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় মার্চে। এ ঘটনায় তৎকালীন গবর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। দুই ডেপুটি গবর্নরকেও সরিয়ে দেয় সরকার। ঘটনা তদন্তে সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি করে সরকার। তবে টাকা উদ্ধার ও মামলা সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বিভিন্ন সময়ে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে এ কারণে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, অর্থ স্থানান্তরের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সেবাদাতা সংস্থা সুইফটকে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) হ্যাক করেই এ অর্থ চুরি করা হয়। সুইফটের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের কোন আদেশ দেয়া হলে তার একটি কপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদেশদাতা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট হওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এসব অর্থ পরিশোধের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চায় ফেড। এরপরই বিষয়টি জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগেই ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর হয়ে যায়। এ ঘটনায় ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নরকে ফোন করে অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে সহায়তা চান তৎকালীন গবর্নর ড. আতিউর রহমান। এছাড়া ফিলিপিন্সে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি দল। এরপর দফায় দফায় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, গবর্নরসহ অনেকে অর্থ উদ্ধার নিয়ে ফিলিপিন্সে, সুইফট কর্তৃপক্ষ ও ফেডের সঙ্গে সভা করে। ঘটনার তিন বছরের মাথায় মামলাটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে ফিলিপিন্সের ব্যাংক আরসিবিসি ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশকে কোন অর্থ ফেরত দেয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়িত্ব অস্বীকার করে তারা বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা ও অসাবধানতার দায় বাংলাদেশকেই নিতে হবে। চুরি হওয়া অর্থ ফিলিপিন্স থেকে অন্য দেশে পাচার হয়ে গেছে। অর্থ উদ্ধারে ফিলিপিন্সের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত মামলায় যেতে হলো। সম্প্রতি রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ মামলা করবে। এক্ষেত্রে ফেডারেল রিজার্ভ বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। তিনি বলেন, অর্থ উদ্ধারসহ দোষীদের শাস্তি হবে এটাই বাংলাদেশ চাওয়া। আশা করছি মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ন্যায় বিচার পাবে। এর আগে অবশ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, সরকার অর্থ ফেরত আনার পথ খুঁজছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আগামী মার্চের আগেই মামলা করা হবে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এ মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ল’ ফার্ম কোজেন ও’কনর। মামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আরসিবিসির কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ল’ ফার্ম কুইন ইমানুয়েলকে ইতোমধ্যে এ মামলা লড়ার দায়িত্ব দিয়েছে তারা। শুক্রবার ম্যানিলা স্টক এক্সচেঞ্জকে বিষয়টি জানানোও হয়েছে। মামলার এজাহারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করে বলা হয় কয়েক বছর ধরে জটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেড-এ রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ভুয়া এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। এছাড়া বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ভুয়া তথ্য দিয়ে খোলা চারটি এ্যাকাউন্টে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ওই এ্যাকাউন্টগুলোর ওপর আরসিবিসি এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে তা জেনেও এ্যাকাউন্ট খোলা, বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর এবং পরে এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার বিষয়গুলো ঘটতে দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
×