ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধকালীন এক টুকরো বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধকালীন এক টুকরো বাংলাদেশ

জনসংখ্যা এবং আয়তনে ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য ত্রিপুরা। এর আয়তন সাড়ে দশ হাজার বর্গকিলোমিটার। বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ লাখের কাছাকাছি। ত্রিপুরার তিন দিকেই বেষ্টন করে আছে বাংলাদেশ। তাই এটি বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। সীমিত বাজেট নিয়েও ঘুরে আসতে পারেন ত্রিপুরা। সময়ও খুব একটা বেশি লাগবে না। অসংখ্য দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে ত্রিপুরায়। বিশেষ করে সম্প্রতি ত্রিপুরায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে নির্মিত হয়েছে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান’ নামের আন্তর্জাতিক মানের একটি পার্ক। যার প্রতি ইঞ্চি জমিতে নানা নান্দনিকতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম এবং এর ইতিহাস। রয়েছে ভারতীয়দের অবদানেরও বহু স্মৃতি। তৎকালীন ত্রিপুরা সরকারসহ আপামর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শুধুমাত্র শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি। বরং মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে ত্রিপুরাবাসী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। তাই এ উদ্যান দুই দেশেরই ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে উঠেছে। ত্রিপুরা ভ্রমণে এই মৈত্রী উদ্যান হবে সবার আগে দর্শনীয় স্থান। ত্রিপুরার কেন্দ্রবিন্দু আগরতলা বিভিন্ন ভাবে যাওয়া যায়। তবে সহজতম পথ হচ্ছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউরা সীমান্ত হয়ে যাওয়া। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সর্বোচ্চ ঘণ্টা চার-পাঁচেকের মধ্যে আগরতলা পৌঁছানো যাবে। কলকাতা থেকে বিমানে মাত্র ৫৫-৬০ মিনিটের দূরত্ব। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা পৌঁছে সবার আগে যাবেন ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান।’ এটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত হয়েছে। এই উদ্যানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোন দেশে প্রথম বারের মতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থান সংরক্ষণ করা হলো। দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া মহকুমার চোত্তাখোলায় ১২০ একর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উদ্যান। মূলত চোত্তাখোলা পঞ্চায়েতের রাজনগর নামের গ্রামটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে। রাজনগর বাংলাদেশের ফেনী জেলার নিকটবর্তী ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে চারদিকে পাহাড়ঘেরা রাজনগর গ্রামটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী ও শরণার্থীদের অলিখিত ঠিকানা। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের শুরুতে এখানে আশ্রয় দেয়া হতো। পরবর্তীতে তাদের ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়া হতো। একাত্তরের মে মাস থেকে রাজনগর গ্রাম শরণার্থীদের ট্রানজিট ক্যাম্পের পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা হয়। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, চোত্তাখোলার গহীন অরণ্যে পুরনো একটি মসজিদ খুঁজতে গিয়ে বাম দলের নেতা সুধন দাস ১৯৯৩ সালে রাজনগর গ্রামের ইতিহাস প্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন। সুধন দাস পরে বিধায়ক নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ পার্ক’ নির্মাণ করেন। পরের বছর ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ঢাকা সফর করেন। সফরকালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে এর নামকরণ করা হয় ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান।’ ২০১০ সালের ১১ নবেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি মৈত্রী উদ্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দীর্ঘ আট বছর নির্মাণ কাজ চলার পরে ২০১৭ সালের শুরুতে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার মৈত্রী উদ্যানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। আগরতলা থেকে মৈত্রী উদ্যানের দূরত্ব প্রায় দেড় শ’ কিলোমিটার। পুরো পথটাই আঁকাবাঁকা মনোরম পাহাড়ী পথ। ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রো রিজার্ভ করে যাওয়া যায়। উদ্যানে পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন-চার ঘণ্টা। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত উদ্যান খোলা থাকে। জনপ্রতি টিকেট মূল্য দশ টাকা। উদ্যানজুড়ে যেন মুক্তিযুক্তকালীন আস্ত একটি বাংলাদেশ উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের কৃতী ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শিল্পী হাশেম খান, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও অধ্যাপক মেসবাহ কামালের পরিকল্পনা ও নকশায় এবং ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় এ উদ্যান তৈরি হয়েছে। নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছেন ত্রিপুরার চারু-কারুকলা ইনস্টিটিউটের শিল্পীরা। বাংলাদেশের খুলনায় অবস্থিত ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’-এর সৌজন্যে এখানে স্থাপিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য পার্ক।’ ভাস্কর্যের মাধ্যমে এখানে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধক্ষেত্রের নানা দৃশ্য। দেয়ালে উৎকীর্ণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ ও ২৫ মার্চ মধ্যরাতের স্বাধীনতার ঘোষণা। জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে ৫২ ফুট উচ্চতার স্মৃতিসৌধ। যার প্রতিবিম্ব লেকের জলে অপূর্ব আবহের সৃষ্টি করে। মৈত্রী উদ্যানে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়বে তর্জনী উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য। তৈরি করা হয়েছে একাত্তরের গণহত্যা জাদুঘর মঞ্চ। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর। যুদ্ধের সময়ে তৈরি করা বাংকারগুলো অবিকল রাখা হয়েছে। ২০ হেক্টর জায়গাজুড়ে রয়েছে ইকোপার্ক। যার মাঝে আছে সাতটি টিলা এবং একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা। রয়েছে ঝুলন্ত সেতু। উদ্যানে প্রবেশের রাস্তাটিও অপূর্ব। গোটা উদ্যানের রাস্তায় নকশা টাইলস দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। ফাইবার গ্লাস ও মাটির টেরাকোটার ভাস্কর্যে টিলার ওপর এবং দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের নানা মুহূর্ত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরোদিন ঘুরেও উদ্যান দেখে শেষ করা যাবে না। পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলা পর্যটন নিবাসে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সময় কাটানো যেতে পারে। সম্প্রতি এক বিকেলে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল মৈত্রী উদ্যান পরিদর্শন করেন। আমরা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা যখন সেখানে পৌঁছাই তখন বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদ্যানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাদের স্বাগত জানান। সে সঙ্গে তুলে ধরেন উদ্যানের নানা খুঁটিনাটি। উদ্যান কর্মকর্তা সুরেন্দ্র নাথ জানান, প্রতিদিনই উদ্যানে মানুষের ঢল নামে। বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে ব্যাপক আগ্রহী। এই উদ্যান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেবে। একই সঙ্গে ত্রিপুরার আপমর মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছেন, তাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগরতলা শহরে ভাল ও মধ্যম মানের অনেক হোটেল রয়েছে। এগুলোর ভাড়া মোটামুটি এক-দুই হাজারের মধ্যে। হোটেলের খাবার পুরোপুরি বাঙালিয়ানা। তাই অল্প খরচে একবার দেখে আসতে পারেন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান।
×