ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

গেণ্ডারিয়া ও ডেমরায় তিন শিশু হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১০ জানুয়ারি ২০১৯

গেণ্ডারিয়া ও ডেমরায় তিন শিশু হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার জের ধরে রাজধানীর গে-ারিয়ায় এক শিশুকে আর ডেমরায় দুই শিশুকে হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত তিনজনই কন্যাশিশু। গেণ্ডারিয়ার শিশুটিকে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলে আর ডেমরার দুই শিশুকে লিপস্টিক দেয়ার লোভ দেখিয়ে বাসায় ডেকে নেয়া হয়েছিল। গে-ারিয়ার শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিন তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতকের বিরুদ্ধে তারই মেয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে। ঘাতকের বাড়ি থেকে নিহত শিশুর প্যান্ট ও খেলনা পুতুল উদ্ধার হয়েছে। আর ডেমরার দুই শিশুকে হত্যাকারী দুইজন সম্পর্কে মামাত ভাই। এ দু’জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে বলেছে, দুই শিশুকে তারা বাসায় ডেকে নেয়ার পর ইয়াবা সেবন করে। এরপর ধর্ষণের চেষ্টা করে। চিৎকার করলে তারা উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ধর্ষণ করতে না পেরে তাদের হত্যা করে লাশ খাটের নিচে শুইয়ে রাখে। বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ফরিদ উদ্দিন তিন শিশুর তিন হত্যাকারীর বরাত দিয়ে হত্যাকা-ের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। গে-ারিয়ায় যেভাবে হত্যা করা হয় শিশু আয়েশাকে ॥ ওয়ারী বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার ফরিদ উদ্দিন বলেন, গত ৫ জানুয়ারি শনিবার বিকেলে গে-ারিয়ায় ঘটে শিশু আয়েশার লোমহর্ষক হত্যাকা-ের ঘটনা। গে-ারিয়ার দীননাথ সেন রোডের ৫৩/১/ছ নম্বর চার তলা বাড়িটির পাশেই টিনশেড বস্তিতে পিতামাতা আর তিন বোনের সঙ্গে থাকত তিন বছর বয়সী আয়েশা। বিকেলে সাধনা ঔষধালয়ের গলিতে খেলতে যায়। এ সময় ৫৩/১/ছ নম্বর বাড়ির মালিক নাহিদ (৪৫) খিচুড়ি খাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাকে ডেকে তার তিন তলার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ সময় শিশুটি মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি করতে থাকে। পাশের রুমেই শুইয়ে ছিল ধর্ষণচেষ্টাকারী নাহিদের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীপড়ুয়া ফাতেমা জাহান বুশরা। সে মেয়েটির কান্নার শব্দ শুনে তার পিতার রুমে যায়। সে শিশুটিকে তার পিতার কোলে বসে থাকতে দেখে। নাহিদ তার মেয়েকে এ রুমে যাওয়ার জন্য ধমক দেয়। পরে মেয়েটি তার রুমে চলে যায়। খানিক পরেই নিচে একটি শব্দ হয়। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কান্নাকাটির আওয়াজ হয়। সেখানে নিচে ব্যাডমিন্টন খেলছিল স্থানীয় যুবকরা। এ সময় বুশরাও ঘটনা জানার জন্য নিচে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময়ও তার পিতা তাকে ধমক দেয়। পরে বুশরা গিয়ে দেখে যে মেয়েটিকে তার পিতার রুমে ছিল, সেই মেয়েটিই পড়ে মরে আছে। মেয়েটির তথ্য মোতাবেক তার পিতাকে গ্রেফতার করতে যায় পুলিশ। এ সময় নাহিদ বাসার তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় নাহিদের দুই পা ভেঙ্গে যায়। তাকে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা শেষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বুশরা আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছে। ওই ঘটনায় শিশু আয়েশার পিতা ইদ্রিস আলী রবিবার গে-ারিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, অভিযুক্ত নাহিদ এক সময় পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে ব্যবসা করত। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর নাহিদ দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনিও চলে যান। নাহিদের মাদকাসক্তির কোন তথ্য মেলেনি। তবে তার মানসিক সমস্যা থাকার কথা বলেছেন এলাকার অনেকেই। বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়ার আশায় নাহিদের মানসিক সমস্যা থাকার কথা বলা হচ্ছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ডেমরায় যেভাবে হত্যা করা হয় শিশু নুসরাত ও ফারিয়াকে ॥ ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ফরিদ উদ্দিন বলেন, গত ৭ জানুয়ারি সোমবার রাত নয়টার দিকে ডেমরা থানাধীন কোনাপাড়ার হযরত শাহজালাল রোডের নাসিমা ভিলার নিচতলার একটি কক্ষ থেকে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে ডেমরা থেকে গ্রেফতার করা হয় গামের্ন্টস শ্রমিক গোলাম মোস্তফা (২৮) ও তারই মামাত ভাই আজিজুল বাওয়ানীকে (৩০)। এদের বরাত দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গোলাম মোস্তফা স্ত্রী সন্তান নিয়ে ওই বাড়ির নিচতলায় ভাড়ায় থাকে। তার স্ত্রীও গার্মেন্টস শ্রমিক। সে অফিসে যায়। এই সুযোগে গোলাম মোস্তফা তারই মামাত ভাই আজিজুলকে ডেকে বাসায় নিয়ে যায়। তারা দু’জনে গোলাম মোস্তফার স্ত্রীর লিপস্টিক নেয়। সেই লিপস্টিক দেখিয়ে তা দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে বাড়ির পাশে খেলতে থাকা নুসরাত ও ফারিয়াকে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। ঘরে শিশুদের লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয় মোস্তফা। শিশুরা ঘরের ভেতরে খেলতে থাকে। এই সুযোগে দুই ভাই ঘরের ভেতরেই ইয়াবা সেবন করে। এরপর মোস্তফা নুসরাতকে আর আজিজুল ফারিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। দুই শিশু কান্নাকাটি শুরু করে। এ সময় দুই ভাই ঘরে থাকা ক্যাসেট প্লেয়ার উচ্চশব্দে বাজিয়ে দেয়। যাতে শিশুদের কান্নার শব্দ বাইরে না যায়। বাইরে থেকে কেউ শব্দ শুনতে না পায়। ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে আজিজুল ফারিয়াকে গলা টিপে হত্যা করে। আর মোস্তফা নুসরাতকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর আজিজুল লাশ খাটের নিচে রেখে পালিয়ে যায়। আর মোস্তফাও নুসরাতের লাশ ফারিয়ার লাশের পাশে খাটের নিচে রেখে দেয়। মোস্তফা ঘরেই থাকে। মোস্তফার স্ত্রী সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফেরেন। এ সময় তার স্বামী মোস্তফা অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। মোস্তফার স্ত্রী মেঝেতে শিশুদের স্যান্ডেল দেখতে পায়। একপর্যায়ে মোস্তফার স্ত্রী বিষয়টি জানতে পারে। সে কৌশলে স্বামীকে ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আশপাশের মানুষজনকে ডাকতে যান। এ সময় মোস্তফার ঘরের ভেতরে থেকে দরজায় আঘাত করে। কাছে গেলে মোস্তফা বলে, তার স্ত্রী ভুল করে ঘরের দরজা বাইর থেকে লাগিয়ে দিয়েছে। একটু খুলে দেন। দরজা খুলে দিলে মোস্তফা পালিয়ে যায়। পরে মানুষজন গিয়ে খাটের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করে। পরে পুলিশ লাশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। মোস্তফা একটি সিরামিকের কারখানায় আর আজিজুল একটি বেকারিতে কাজ করে। নিহত শিশু দুইটি স্থানীয় স্কুলে নার্সারিতে পড়ত। এ ঘটনায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিহত নুসরাতের পিতা পলাশ হাওলাদার বাদী হয়ে দুই জনের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। বিকেলে মোস্তফা ও আজিজুল ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি গঠন ॥ ডেমরায় দুই শিশু হত্যার ঘটনায় বুধবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল মাহমুদ সাইদুল কবীর। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক সুস্মিতা পাইক ও উপপরিচালক এম রবিউল ইসলাম। বুধবার কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার মধ্যদিয়ে তদন্ত শুরু করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
×