ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নেপথ্যে সেনাবাহিনী ॥ পাকিস্তানে মিডিয়া দমন

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

নেপথ্যে সেনাবাহিনী ॥ পাকিস্তানে মিডিয়া দমন

পাকিস্তানে গত বছর সংবাদপত্র তথা মিডিয়া নজিরবিহীন দমনীতির শিকার হয়েছে। এই দমন নিপীড়নের পিছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আগের সরকারগুলোও যে সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে প্রবল চাপের মুখে রাখেনি তা নয়। তবে মিডিয়া জগতে কর্মরত অনেকেই অভিযোগ করেছে যে গত বছর তাদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দমন-পীড়ন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু ঘটনা আছে যা থেকে এমন অভিযোগের সত্যতা মেলে। গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ ভয়েস অব আমেরিকার পশতু ভাষায় প্রচারিত রেডিও সার্ভিসের ওয়েবসাইট আটকে দেয়। এরপর ৮ ডিসেম্বর পুলিশ পশতুদের অধিকার দাবিতে আন্দোলনরত পশতু তাহফুজ মুভমেন্টের এক সমাবেশের পর কয়েক ডজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে যাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিকও ছিলেন। তাদের একজন ‘ডন’ পত্রিকার সাংবাদিক সাইলাব মাসুদ ও অন্যজন স্থানীয় চ্যানেল খাইবার টিভির জাফর ওয়াজির। ১৪ ডিসেম্বর সরকারের তরফ থেকে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে সহিংসতা, অপহরণ, যৌন নিগ্রহ, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতির মতো ইস্যুর ওপর খুব বেশি প্রতিবেদন না করতে বলে দেয়া হয়। এর আগে জুলাই মাসেও মিডিয়াকে বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর খবর পরিবেশন না করতে বলা হয়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষ মিডিয়া হাউস জং গ্রুপ তার বেশ কিছু মিডিয়া আউটলেট বন্ধ করে দিয়ে শত শত স্টাফকে একসঙ্গে বরখাস্ত করে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও অধিকতর সরকারবান্ধব খবর পরিবেশনে বাধ্য করতে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিজ্ঞাপন দেয়া না দেয়া এবং তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আর্থিক কলকাঠি প্রয়োগ করার কৌশল নেয়া হয়। পাকিস্তানের মিডিয়া জগতের নিউজ রুমগুলোতে ক্রমবর্ধমান চাপ ও সেন্সরশীপের কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে হাতাশা বিরাজ করছে। পাকিস্তানী এসটাবলিশমেন্টের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত কিছু সাংবাদিক যেমন তালাত হোসেন, মুর্তজা সোনাঙ্গি, মাতিউল্লাহ জান নুসরাত জাভেদ হয় চাকিরচ্যুত হয়েছেন নয়ত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অথচ বাহ্যিক চেহারায় দেখলে মনে হবে পাকিস্তানের সংবাদপত্র তথা মিডিয়া জগতের স্বর্ণযুগ চলছে। উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনতা ভঙ্গ করছে। টিভি চ্যানেলগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। পত্রিকায় ভিন্নমতের কলামিস্ট ও সামাজিক মাধ্যমে জনমত গঠনকারী ব্যক্তিরা গিজ গিজ করছে। বাহ্যিক চেহারা যাই থাক প্রকৃত চিত্রটা বড়ই নির্মম। মিডিয়া চলে সরকারী সংস্থা ও রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনে। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে তারা কোনভাবে টিকে আছে। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো আছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর একটা প্রবণতাই হলো সব ধরনের সমালোচনার মুখ বন্ধ করার জন্য নেপথ্যে থেকে সাংবাদিক ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। শুধু সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমালোচনাই নয়, এমনকি সরকারের যেসব নীতি তাদের অতি পছন্দের সেগুলোর সমালোচনাও তারা বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। সেনাবাহিনী মনে করে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি কোনটি হুমকি বা হুমকি নয় তা বিচার করার একমাত্র অধিকার তাদেরই রয়েছে। দু’বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের পূর্বসূরি নওয়াজ শরীফ উগ্রপন্থীদের সহিংসতা মোকাবেলায় সেনা সমর্থন চেয়ে জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। ঐ বৈঠকই ছিল নওয়াজের পতনের সূচনা। কারণ নওয়াজ যেসব জঙ্গী গোষ্ঠীকে দমন করতে চাইছিলেন সেগুলোকে সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেছিল। যেমন হাক্কানী নেটওয়ার্ক। এরা আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব প্রসারিত করার হাতিয়ার। অন্যদিকে লস্কর-ই-তৈয়বা ভারতকে অস্বস্তি বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ফেলতে কার্যকর। ভারত ও আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এই দুই জঙ্গী গোষ্ঠীকে ইসলামাবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দান। নেওয়াজ এ অবস্থাটা পাল্টাতে চেয়েছিলেন এবং তা করতে গিয়েই সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হন। জেনারেলদের সঙ্গে সেই বৈঠক শুধু নওয়াজেরই পতনের সূচনা ছিল না এর মধ্য দিয়ে দেশের সুপরিচিত পত্রিকা ‘ডন’ এর উপরও দমন নির্যাতনের খগড় নেমে আসে। কারণ পত্রিকার তারকা কলামিস্ট সিরিল আলমিদা জেনারেলদের সঙ্গে নেওয়াজের জটিল টানাপোড়েনের অনেক ভেতরের কাহিনী ফাঁস করে দিয়েছিলেন। তাই নির্বাচনের ঠিক আগে সহসা দেখতে পাওয়া যায় যে পাকিস্তানের রেশ কিছু নগরীতে ‘ডন’ পত্রিকাটিকে পরিবেশিত বা বিক্রি হতে দেয়া হচ্ছে না। আলমিদার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের বানোয়াট অভিযোগ আনা হতে পারে। মিডিয়ার অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে তারা জনজীবনে সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে কোন কিছু লিখতে বা পরিবেশন করতে পারেন না। উল্টো বরং ইমরানকে সমর্থন দিতে তাদের ওপর প্রবল চাপ থাকে। তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বেলুচিস্তান প্রদেশে কিম্বা উত্তরের উপজাতীয় এলাকাগুলোতে স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তাদের গুম হয়ে যাওয়া। রাজনীতিকদের ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে লিখলে ভাল। কিন্তু সেনা অফিসারদের এত জমি কেন কিভাবে বরাদ্দ দেয়া হলো তা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। যেমন সাবেক সেনাপ্রধান রাহেল শরীফ অবসর নেয়ার পর লাহোরের বাইরে ৯০ একর জমি পেয়েছেন। ব্লগাররা সেনাবাহিনীর সমালোচনা করলে সেনা হেফাজতে গুম হয়ে যায়। পরে পোষমানা প্রাণী হয়ে পুনরাবির্ভূত হয়। প্রকাশক ও প্রযোজকরা জানান, কি ছাপতে হবে কিভাবে ছাপতে হবে সে সংক্রান্ত নির্দেশ সেনা অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়ে দেয়া হয় অথবা অজ্ঞাত নম্বর থেকে টেলিফোনে বলে দেয়া হয়। পত্রিকা বা চ্যানেল বন্ধের হুমকি অহরহই পাওয়া যায়। এ পরিবেশে সেল্ফ সেন্সরশীপ বাড়ছে। সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য মামলা করা হচ্ছে। এমন প্রতিকূল অবস্থা আগে কখনও দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন এক প্রবীণ সাংবাদিক। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×