ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ক্যাডা যে মিছা কতা কয়া ভয় দেখায়’

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

‘ক্যাডা যে মিছা কতা কয়া ভয় দেখায়’

সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস ॥ চাঁন মিয়ার বয়স ৭০ অতিক্রম করেছে। এই জীবনে সবগুলো সাধারণ নির্বাচন দেখেছেন। লোকজনের নানা কথায় এবারের নির্বাচন (একাদশ) নিয়ে তার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল- কি জানি কি হয়। সকালে তিনি ভয়ে ভয়েই তার ভোট কেন্দ্র গাবতলীর চকবোচাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে যান। প্রবেশের সঙ্গেই এলাকার স্বেচ্ছাসেবকরা তার কাছে গিয়ে ভোট প্রদানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে তিনি ভড়কে যান। পরে বুঝতে পারেন যা মনে করছেন তা নয়। তরুণরা তাকে ভোটার নম্বরের স্লিপ হাতে দিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। কক্ষের দুয়ারে প্রহরারত অস্ত্রধারী আনসার তাকে সহযোগিতা করে ভেতরে প্রবেশ করান। এরপর তিনি নিয়ম মতো ব্যালটে সিল দিয়ে ভোট প্রদান করে ভোট বাক্সে ফেলেন। হাসিমুখে বের হয়ে সঙ্গীদের বলেন ‘ক্যাডা যে মিছা কতা কয়া ভয় দেখায়! কি হলো সোন্দর ভোট দিয়্যা আল্যাম (কে যে মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখায়। কি হলো সুন্দর ভোট দিয়ে এলাম)।’ তিনি তার সঙ্গে আসা প্রবীণ বুলু মিয়াকেও (৬৫) ভোট দেয়ার পথ দেখান। তাদের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পদ্মপাড়া গ্রামে। একই গ্রামের গৃহবধূ রোজিনা আক্তার বললেন ‘কেউ কিছু কলো না। হামি লিশ্চিন্তে ভোট দিয়্যা আল্যাম (কেউ কিছু বলেনি। আমি নিশ্চিন্তে ভোট দিলাম)।’ তখন বেলা ১১টা। প্রিসাইডিং অফিসার জহুরুল ইসলাম তথ্য দিলেন- এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৩১০ জন। এই সময় পর্যন্ত ১৪০০’র বেশি ভোটগ্রহণ হয়েছে। একই চিত্র দেখা গেল যমুনা তীরের বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩৩৯৮। দুপুর ১২টার দিকে প্রিসাইডিং অফিসার শুভাশীষ সরকার জানালেন ততক্ষণে অর্ধেকেরও বেশি ভোটগ্রহণ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ (৭০) বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই তিনি ভোট দিয়েছেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন প্রজন্মের কয়েক তরুণ। তাদের কথা- পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই তারা হাঁটবেন। গড়বেন আধুনিক বাংলাদেশ। এই কেন্দ্র থেকে হেঁটে যাওয়া দূরত্বে সারিয়াকান্দি পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে দেখা হয় এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। এবারও তিনি প্রার্থী। বললেন, এই এলাকার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। কেউ কোন অভিযোগ করেনি। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। গ্রামের জাহানারা বেগম (৫০) বললেন, সকালে ভোট দিতে যাবেন বলে রান্নার কাজ আগেই সেরে নিয়েছেন। এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা যায়। অবাধে ভোট দিয়ে খুশি শতায়ু তহিমুদ্দিন নিজস্ব সংবাদদাতা সান্তাহার থেকে জানান,বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া) আসনের আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার পৌরসভার মালশন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবাধে ভোট দিতে পেরে বেজায় খুশি শতায়ু তহিমুদ্দিন। পৌরসভা এলাকার সাহেবপাড়া মহল্লায় রেলওয়ের জমিতে বস্তিঘড় তৈরি করে বসবাস করেন তহিমুদ্দিন। তার বর্তমান বয়স ১১৫ বছর বলে দাবি করেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ তহিমুদ্দিন। তিনি বলেন ভিক্ষা করতে ৮৫ বছর বয়সে সান্তাহার আসেন। কিছুদিন প্লাটফর্মে বসবাস করেন। তারপর থেকে বসবাস করছেন সাহেবপাড়ায়। আদি বাড়ি নিলফামারী জেলার চিলাহাটিতে। রবিবার বেলা ১১টার দিকে ওই কেন্দ্রে একজনের সাহায্যে ভোট দিয়ে বের হয়ে আসার পর এই প্রতিনিধির কথা হয় তার সঙ্গে। কাকে ভোট দিলেন মুরব্বি প্রশ্ন করলে তিনি অকপটে বলেন, ‘মুই শ্যাখের বেটির নোক (শেখ হাসিনা মনোনীত মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি) এর লাঙ্গল মার্কায় দিচি বাহে’। কেউ কোন বাধা দিয়েছে কি-না জানতে চাইলে বলেন ‘না বাহে মোক তো একজনা সাহায্য করিল ভোট দিবার নাগি (একজন তাকে বুথে নিয়ে গিয়ে ভোট দিতে সহযোগিতা করেছে)’। বয়স কত হয়েছে জানতে চাইলে ১১৫ বছর বলে জানান। জন্মের সাল কত জানতে চাইলে, বেশ দৃঢ়ভাবে বলেন ‘মুই হইছি ১৯০৩ সালত (আমার জন্ম সাল ১৯০৩)’। ভোট দিমের পামো চিন্তাই করি নাই স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, দেশের বৃহত্তম ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার মানুষ উৎসবের মধ্যদিয়ে তাদের জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে পেরে মহাখুশি। রাশমেলার ষাটোর্ধ মোক্তার আলী জানান, ‘বুইড়া বয়সোৎ এমপি ভোট দিয়া খুব আনন্দ পাইছি ভাইজান।’ ওই এলাকার টংকার মোড়ের রুজিনা জানান, ভোট দিমের পামো চিন্তাই করি নাই। যাই হামাক পরিচয় দিছে তার প্রার্থিক ভোটটা দিছি।’ কুড়িগ্রামে ১২ ছিটমহলের মধ্যে ১১টি ছিটমহলে মানুষ বসবাস করেন। এখানে ১ হাজার ৮শটি পরিবারে প্রায় ৯ হাজার মানুষ রয়েছে। মোট ভোটার প্রায় ৪ হাজার। এরমধ্যে দাসিয়ারছড়ায় ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ১৭২ জন। দাসিয়ারছড়ার মানুষ ৫ ভোট কেন্দ্রে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- পশ্চিম কুটি চন্দ্রখানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চন্দ্রখানা উচ্চ বিদ্যালয়, চন্দ্রখানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আটিয়াবাড়ি ১নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছড়ারপাড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে পূর্ব চন্দ্রখানা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এই কেন্দ্রে ৩ হাজার ৬৮৮টি ভোটের মধ্যে ১ হাজার ৮শ’টি ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখানে ফুলবাড়ী ডিগ্রী কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশমেলা গ্রামের আজিজুল হক জানান, এই কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন ভোটার তাদের ভোট দিতে এসে জানতে পারেন তাদের ভোট আগেই দেয়া হয়েছে। তারা ভোট না দিয়েই ফিরে যান। পার্শ্ববর্তী ১নং আটিয়াবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর দেড়টায় ২ হাজার ৭শ’ ভোটের মধ্যে ২ হাজার ১শ’ ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সকলেই ভোট দিতে পেরেছে বলে জানান টংকার মোড় এলাকার মোক্তার আলী, ফিরোজ, ফাতেমা ও রুজিনা। এখানে সকাল ৮টা থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। সকালে ছিল দীর্ঘ ভোটারদের সারি। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষরা লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ভোট প্রদান করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে। মির্জাপুরে ১২৫ বছরের বৃদ্ধ নিজস্ব সংবাদদতা মির্জাপুর থেকে জানান, মির্জাপুরে ১২৫ বছর বয়সেও বৃদ্ধ আইন উদ্দিন মিয়া ভোট দিলেন। মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের দেওহাটা এ জে উচ্চ বিদ্যালয়ে দুপুরে তিনি ভোট দেন। আইন উদ্দিনের বাড়ি কদিম দেওহাটা গ্রামের কচুয়াপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম হাসেম উদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে তার জন্ম ১০ মে ১৮৯৩। সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স ১২৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন। মক্তব পাশ বয়সের ভারে নুহ্য আইন উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন সব আন্দোলনেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ১৯৫৪ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে হক ভাষানীর যুক্তফ্রন্টের নৌকা মার্কায় ভোট দেন। পরবর্তীতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনেও সক্রিয়ভাবে তিনি অংশ নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ প্রতিটা নির্বাচনেই তিনি অংশ নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট দেন বলে জানিয়েছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে কেন ভোট দিতে এলেন তা জানতে চাওয়া হলে শতবর্ষী আইন উদ্দিন জানান, শেখের বেটি ভোটের আয়োজন করেছেন। এ খবর জানতে পেরে ঘরে থাকতে পারিনি। তাই নাতি মোশারফ হোসেন ও ভাতিজা মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানকে বলে ভ্যান গাড়িতে চেপে প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে ভোট দিতে এসেছি। এত বয়সেও তিনি চশমা ছাড়া চোখে দেখতে তার কোন অসুবিধা হয় না।
×