ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন থেকে সরে পড়ার চেষ্টা ঐক্যফ্রন্টের!

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন থেকে সরে পড়ার চেষ্টা ঐক্যফ্রন্টের!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে বিএনপি-গণফোরামের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক মোর্চা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট। কিন্তু বাংলাদেশে নিযুক্ত একাধিক প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে কামাল হোসেনসহ বিএনপি নেতাদের একটি অংশ। তাছাড়া এক সপ্তাহে বিএনপি নেতাদের ফাঁস হওয়া টেলিফোন সংলাপ ও কামাল হোসেন হত্যা ষড়যন্ত্র ইস্যু আরও স্পষ্ট করেছে বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে চায়। এদিকে নির্বাচন করা না করা ইস্যুতেও বিএনপির মধ্যে দুটি পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তারেক রহমান, মওদুদ আহমদসহ একটি পক্ষ চায় নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসতে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে অপর পক্ষটি চায় যে কোন মূল্যে নির্বাচনের মাঠে থাকার। যদিও শনিবার বিকেল পর্যন্ত কামাল হোসেনসহ বিএনপি নেতারা নির্বাচনের মাঠে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এতেও স্বস্তি মিলছে না কোন পক্ষ থেকেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঐক্যফ্রন্ট সর্বশেষ নির্বাচনের মাঠে থাকবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া দেশী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ বিষয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের নেতারাও বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিতে নারাজ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গণফোরাম যখন নিভু নিভু করে রাজনীতির মাঠে জ¦লছে ঠিক তখন ডুবন্ত অবস্থায় ছিল বিএনপি। তখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণফোরামের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের পরামর্শ দেয়া হয় কামাল হোসেনকে। যার নেপথ্যে দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী রয়েছেন বলে জানা গেছে। কামাল হোসেনকে সার্বিক সহযোগিতা দেয়ার আশ^াসও দেয়া হয় তাদের পক্ষ থেকে। গত সপ্তাহের শেষদিকে রাজধানীর একটি স্থানে কামাল হোসেনসহ ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের কয়েক নীতিনির্ধারক নির্বাচন ইস্যুতে বৈঠকে বসেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক বিষয় তুলে ধরে আলোচনা করেন তারা। এক পর্যায়ে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। খবর পেয়ে বৈঠকে ছুটে যান একজন সাংবাদিক। তিনি কামাল হোসেনকে নির্বাচনে থাকার অনুরোধ করেন। এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ড. কামাল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেই সাংবাদিক বাংলাদেশে নিযুক্ত একটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতকে ঘটনা জানিয়ে কামাল হোসেনকে নির্বাচনে থাকার পরামর্শ দেয়ার অনুরোধ করেন। এরপর আসে সেই কাক্সিক্ষত টেলিফোন। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। প্রশ্ন হলো, কেন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করতে চায়? এ নিয়ে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে রয়েছে নানা আলোচনা। বাংলাদেশেও এই আশঙ্কা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে সবখানেই গুঞ্জন। একদিকে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জেলে। বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তারেক রহমান একদিকে দ-িত অন্যদিকে পলাতক। এই অবস্থায় বিএনপি ভেবেছিল নতুন রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে তাদের পক্ষে গণজোয়ার উঠবে। বিধি বাম! হয়নি। কারণ, ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা একেবারেই তলানীর কোটায়। নামসর্বস্ব দল নিয়ে গঠন হয়েছে নতুন এই জোট। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দেয়া, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ, মৌলবাদী তৎপরতা, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশে জঙ্গীবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছিল। তেমনি মাথাচড়া দিয়ে উঠছিল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াতের তা-বের কথা দেশবাসী মনে রেখেছে। আগুনসন্ত্রাসের কারণে অনেক পরিবার হারিয়েছে স্বজন। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতসহ উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর অশুভ তৎপরতা সবার চোখে এখনও উজ্জ্বল। তাই ২০ দলীয় জোটসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২৯৯ আসনে প্রার্থী থাকলেও ভোটারদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। বিষয়টি অনেকটা আঁচ করতে পেরে এবারের নির্বাচনে প্রচারে কার্যত খুব একটা মাঠে নেই প্রার্থীরা। তাই ফ্রন্ট নেতাদের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ মানেই ভরাডুবি নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। মহাজোটের বিজয় অনেকটা নিশ্চিত জেনেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করে ফ্রন্ট নেতারা। এদিকে ২৫টি আসনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে। প্রচার শুরুর পর থেকে জামায়াতও অনেকটা চুপচাপ। সবার ধারণা, আজ নির্বাচনের দিন জামায়াত-বিএনপি বড় ধরনের নাশকতা করতে পারে। মূলত নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্য থেকেই এ রকম অঘটন ঘটাতে পারে তারা। এদিকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অনেক নেতার ধারণা, ভোটের দিন কৌশলী অবস্থান নিয়ে নির্বাচন বর্জন করতে পারে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট ঐক্যফ্রন্ট। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে মাঠে থাকবে জাতীয় পার্টি। এতে জাপার বিরোধী দলে আসার সম্ভাবনা প্রবল। মূলত এ রকম চিন্তা থেকেই জাপার প্রার্থীদের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও দলটির অপর প্রভাবশালী নেতা বরকতউল্যাহ বুলুর টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয়েছে শুক্রবার। এতে বিএনপিতে নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। একটি পক্ষ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য সর্বশেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। টেলিফোন সংলাপে মওদুদ বলেছেন, দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার স্বার্থে নির্বাচন করছেন তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি তাহলে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে নির্বাচন করছেন। আমরা নির্বাচন না করে ৩০০ প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে এনে রাস্তায় বসে পড়লেই খবরটি বিশে^ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারত বলেও যোগ করেন মওদুদ। তিনি বলেন, ফখরুল ইসলাম আমার ফোন ধরে না। তার পিএসও ফোন ধরে না। আমি সবকিছু তারেক রহমানকে জানিয়েছি। তাছাড়া গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসিন মন্টুর সঙ্গে এক ব্যক্তির টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়েছে কয়েকদিন আগে। এতে ল-নে তারেক রহমানের পরিকল্পনায় কামাল হোসেনকে নির্বাচনের আগে হত্যার জন্য নির্দেশ দেয়ার কথা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কামাল হোসেনকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার কথা বলা হয় টেলিফোনে। সব মিলিয়ে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে তা এখন আর হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর কিছু নেই। বিএনপি-জামায়াত তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভোটের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার ষড়যন্ত্রের মধ্যেও ভোটের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের দিন কেউ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা। ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটের প্রস্তুতি বিষয়ে সিইসি জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। এবারের নির্বাচনে ১ হাজার ৮৬১ প্রার্থী রয়েছেন। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তারা প্রচার কাজে মুখরিত হয়েছেন। মিছিল, জনসভা, লংমার্চ, লিফলেট, পোস্টার, ঘরে ঘরে গমনের মধ্য দিয়ে প্রতিযোতিমূলক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এবার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৩ ভোটার ৪০ হাজার ১৮৩ ভোট কেন্দ্রের ২ লাখ ৬ হাজার ৭৬৭টি ভোটকক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন। ইতোমধ্যে সারা দেশে নির্বাচনী উপকরণ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। ইভিএম কেন্দ্রেও সামগ্রী পৌঁছে গেছে। সিইসি জানান ভোট কেন্দ্র, সামগ্রী, এজেন্টদের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটরা কর্মরত আছেন। কেন্দ্রে অবস্থান সবার উপরে। কেননা, কেন্দ্রের সাফল্যের ওপর ভর করে গোটা নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করে। তিনি বলেন, কর্মকর্তা, পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। রিটার্নিং অফিসার ৭টার মধ্যে ভোট পরিচালনার কাজ শুরু করবেন। তিনি ব্যালট বাক্স খুলে সকলের উপস্থিতিতে সকলকে ব্যালট বাক্স খালি কি না দেখাবেন। এরপর ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু করবেন। ভোটগ্রহণ শেষ হলে এজেন্ট, সাংবাদিকদের সামনে ভোট গণনার কাজ শুরু করবেন। কেন্দ্রের বাইরে করা যাবে না। ফলাফলের তালিকা এজেন্টদের সরবরাহ করতে। কেউ অবৈধভাবে ভোটকক্ষ ত্যাগ করতে বললে ম্যাজিস্ট্রেট বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।
×