ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

ভোটের দিন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

ভোটের দিন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে থাকবে কি না এ নিয়ে খোদ দলের ভেতরেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। দলের একাংশ চাচ্ছে নির্বাচনে থাকতে, অপর অংশ চাচ্ছে শোচনীয় পরাজয়ের চেয়ে আগেই বর্জন। আজকালের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সবকিছু বিবেচনা করে পরিস্থিতি প্রতিকূল মনে করলে ভোটের দিন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি। সূত্র জানায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ দলের সিনিয়র নেতাদের একাংশ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচনে থাকার পক্ষে। কিন্তু লন্ডনপ্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের অপর অংশ চাচ্ছে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে শোচনীয় পরাজয়বরণের চেয়ে বর্জনই শ্রেয়। বিষয়টি নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির যে অংশটি নির্বাচনে থাকার পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে- প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিছু আসন পেলে বিএনপি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদাসহ রাজনৈতিকভাবে একটা সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। এর ফলে বিএনপি ঘরে-বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকার পাশাপাশি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অপর পক্ষের যুক্তি হচ্ছে- যেভাবে মামলা-নির্যাতন চালিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে তাতে নির্বাচনে থেকেও খুব বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে ও তারেক রহমান বিদেশে থাকায় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা কে হবে এবং এ দায়িত্ব যাকেই দেয়া হোক পরে বিএনপি হাইকমান্ডের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কি না এমন আশঙ্কা রয়েছে। জানা মতে, মির্জা ফখরুলের সঙ্গে থাকা নেতারা চাচ্ছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন যত অল্পই পাক বিএনপিই বিরোধী দলের মর্যাদায় থাকবে। সে ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ অথবা বগুড়া-৬ আসনের যে কোন একটি আসনে অথবা দু’টি আসনেই বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই মির্জা ফখরুলই জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হবেন। তাহলে দল ও সংসদে মির্জা ফখরুলের অবস্থান সুদৃঢ় থাকবে। তাই দলের সবকিছুতে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণই থাকবে। বিএনপির অপর অংশের নেতারা মনে করছেন, মির্জা ফখরুল এক সময় সংস্কারপন্থী নেতা ছিলেন। তাই বিএনপি শেষ পর্যন্ত এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে থাকলে এবং নির্বাচনের পর সংসদ ও দলে তার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলে যে কোন সময় পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি নতুন করে সঙ্কটে পড়তে পারে। এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় ড. কামালসহ জোটের সব নেতার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই নির্বাচনের পর জোটের নেতারাও মির্জা ফখরুলকেই জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা করতে চাইবেন। তাহলে বিএনপির অন্য অংশের নেতাদের অবস্থান খর্ব হবে। আর এ কারণেই বিএনপির ফখরুলবিরোধী অংশটি চাচ্ছে নির্বাচন বর্জন আগেই তাদের পথ পরিষ্কার করে রাখতে। এদিকে নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপি যাতে বিভিন্ন মহলের বড় ধরনের চাপের মুখে না পড়ে সে জন্য আগে থেকেই নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করে রেখেছে বিএনপি। এমনকি সেনা মোতায়েনের পরও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রতিদিন নির্বাচন কমিশনে গিয়ে, সংবাদ সম্মেলন করে ও বিবৃতি দিয়ে বিস্তর অভিযোগ করছে। নির্বাচন কমিশনে এখন বিএনপির অভিযোগের পাহাড় জমেছে। নানান অভিযোগের পাশাপাশি সিইসির পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নতুন সিইসি নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপও চেয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া দলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার ও অন্য নেতাকর্মীরা এখন এলাকায় থাকতে পারছে না বিএনপির পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ করা হয়েছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করলেও যাতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্যই এসব অভিযোগ করে রাখা হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিএনপির অধিকাংশ অভিযোগের কোন সত্যতা নেই বলে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবসহ ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ঢালাও অভিযোগ করতে থাকলে সিইসি কে এম নুরুল হুদা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে ড. কামাল সিইসির প্রতি ক্ষেপে গিয়ে অনাস্থা প্রকাশ করেন। নির্বাচন বর্জনের ক্ষেত্র তৈরি করতেই একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা এমন আচরণ করেছেন বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা গত ক’দিন ধরে বলে আসছেন ভরাডুবি আঁচ করতে পেরে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি। আর এ জন্যই তারা একের পর এক ঢালাও অভিযোগ করছে। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ দলটির নেতারা বলছেন, মামলা-হামলা দিয়ে হয়রানির পাশাপাশি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচারে নামতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ভোটের দিন যাতে বিএনপি পুলিং এজেন্ট নিয়োগ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপি কিভাবে নির্বাচন করবে? বুধবার ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যেভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে তাতে বিএনপি কিভাবে নির্বাচনে যাবে। তাহলে কি বিএনপি নির্বাচনে থাকবে না-প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, এ বিষয়ে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত হবে। তবে আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে চাই। বিএনপির গুলশান ও নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার কথা বলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. কামালও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার কথা বলেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বিএনপি নেতারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার কথা বললেও অধিকাংশ এলাকায় পোস্টার না লাগানো এবং প্রচার না চালানোর কৌশল দেখে মনে হয় শেষ মুহূর্তে তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে। যেভাবে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশেনের নির্বাচনে ভোটের দিন দুপুরে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এমন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে কৌশলগত কারণে এ বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। উল্লেখ্য, নিরপেক্ষ সরকার ও মুক্ত খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোন অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে না-এমনটি বরাবরই বলে আসছিলেন দলটির সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে নানা শর্ত দিয়ে আসছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যান। অবশ্য ৩ ফেব্রুয়ারি দলের নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি ছয় শর্ত দিয়ে তা মানা হলে নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিত দেন। পরে বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে যেতে ৫ শর্তের কথা জানান। অবশ্য এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিলের আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ৭ দফা দাবি পেশ করেন। ৭ দফা দাবি পেশের পর বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনে তোড়জোড় শুরু করে। এক পর্যায়ে ড. কামালের ঐক্য প্রক্রিয়া ও অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু এ জন্য বিএনপিকে প্রকাশ্যে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের দাবি জানান অধ্যাপক ডাঃ বি. চৌধুরী। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করায় যুক্তফ্রন্ট বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন থেকে দূরে সরে আলাদা নির্বাচনী জোট গঠন করে। আর বিএনপি ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। পরে অবশ্য কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও জোটে যোগ দেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপিসহ জোটের সিনিয়র নেতারা। সংলাপেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ৭ দফা দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া বিএনপি নেতাদের নামে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক মামলা দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে তা বন্ধের দাবি জানানো হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক মামলার তালিকা দিতে বললে দ্বিতীয় দফা সংলাপকালে বিএনপি সহস্রাধিক মামলার একটি তালিকা দেয় এবং পরে আরও সহস্রাধিক মামলার আরেক তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেফতার হয়রানির অভিযোগ আনতে থাকে। এ ছাড়া নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি বলেও তারা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অভিযোগ করেন। পাশাপাশি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে এ ধরনের অভিযোগ করতে থাকেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে ৭ দফা দাবি করেছিল তার মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনকালে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন, সবার জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্য ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অবাধ সুযোগ রাখা, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ না করা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মামলার নামে হয়রানি না করা। বিএনপি নেতাদের মতে এসব দাবির একটিও পূরণ করা হয়নি। তাই তারা নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারছে না। আর কোথাও কোথাও প্রচারে নামলেও হামলার শিকার হয়ে ঘরে ফিরে যেতে হচ্ছে। এদিকে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না এ বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে। বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গত ক’দিনের কথাবার্তা ও নির্বাচনী প্রচারে তেমন আগ্রহ না দেখে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
×