ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মা শুধু বললেন- আত্মসমর্পণের চেয়ে যুদ্ধ করে মরা ভাল’

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

‘মা শুধু বললেন- আত্মসমর্পণের চেয়ে যুদ্ধ করে মরা ভাল’

টগবগে যুবক, সুঠাম দেহের অধিকারী। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। অনেক স্বপ্ন অনেক আশা, বড় হবে, চাকরি করবে করছেও তাই। কিন্তু দেশ তো স্বাধীন না। উর্দু ভাষায় কথা বলা, অন্য দেশের কথা মতো চলা। না, মানি না এসব। সবাই দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছে। আমাকেও যেতে হবে। আমিও যাব যুদ্ধে। নবম শ্রেণী পাস করেই পাকিস্তান আর্মিতে চাকরি নেয়। সেদিন দেশ মাতৃকার টানে মায়ের অসুস্থতা দেখিয়ে চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসে দেশে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় দেশ স্বাধিকার আন্দোলনের আশায়। মা শুধু বললেন, ‘পাকিদের হাতে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা অনেক ভাল’। যাও বাবা, তোমার সঙ্গে শেখ মুজিব ও আমার দোয়া আছে। এই যুবকটি আর কেউ নয়, গফরগাঁও পৌরশহরের ৭নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রামের সিরাজুল হক উরফে বোমা সিরাজ। নিজ বাড়িতে স্বাধীনতার স্মৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের কথা হয়। তিনি বলেন, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের বেলতি স্থানের কোয়েটার ট্রেনিং শেষ করে করাচির মালির ক্যান ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করি। ১৯৭১ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি ৩ মাসের ছুটিতে আসি। ছুটি থাকাকালীন মাথায় চিন্তা এলো আর চাকরিতে যাব না। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা। মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এলাকার যুবক, ছাত্র, উৎসাহী জনতা নিয়ে ইসলামিয়া হাই স্কুল মাঠে ট্রেনিং শুরু করি। এরপর ১৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানী জেট বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে গফরগাঁওয়ের ওপর। দলবল নিয়ে গফরগাঁও থানায় আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি এপ্রিলের শেষের দিকে ত্রিশাল, ভালুকা, গফরগাঁও ছাত্র-যুবক, জনতা নিয়ে ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে ১১নং সেক্টরের অধীনে মল্লিক বাড়ি নামক স্থানে হেড কোয়ার্টারে অবস্থান নেই সবাই। জুলাই/আগস্ট মাসের দিকে পাক বাহিনী ভালুকা আক্রমণ করার জন্য যাওয়ার পথে ভাওয়ালিয়া বাজু বাজার নামক স্থানে পাক বাহিনীদের সঙ্গে দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে শহীন হন আব্দুল মান্নান, আহত হয় আফাজ উদ্দিন ভুঞা নামক একজন। ঐ ৩৬ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধে আনুমানিক ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত হয় দেড় শতাধিক। এরপর নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেজর আফসারের নির্দেশে ত্রিশালের কাশিগঞ্জে ও আমলিতলা বোমা মেরে ২টি ক্যাম্প দখল করি। ঐ যুদ্ধে প্রায় ২৫০জন পাকি সেনা আনসার মোজাহিদ, রাজাকার, আল সামস, আলবদর আত্মসমর্পণ করলেও শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন। আমার দল আগরতলা হাপানিয়া ক্যাম্প থেকে নবীনগর কসবা আলগীরচর হয়ে যুদ্ধে যাই। যুদ্ধে যাওয়ার আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার অওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন ম-ল আমাদের পরিচয়পত্র দেন ভারতের আগরতলা ট্রেনিং করার জন্য। গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল, হোসেনপুর, নান্দাইল এই ৫টি থানায় পাকিদের হেড কোয়ার্টার ছিল গফরগাঁওয়ের ডাকবাংলো। এখানে বসেই চালানো হতো ৫ থানার সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন। একদিন মুক্তিযোদ্ধা বেলাল ভাই ও মেজর আফসার উদ্দিন নির্দেশ দিয়ে বললেন বোমা সিরাজ অপারেশন ডাকবাংলো। কথা ও কাজ নবেম্বরের মাঝামাঝি রাত ১০টার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে ডাকবাংলো পাকিদের হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ করি। দুঃখের বিষয় ঐ দিন বোমা বা গ্রেনেড ম্যামেজ থাকায় কোন কাজেই হয়নি। যে খানেই যুদ্ধ সেখানেই সিরাজ। মনে মনে পণ করলাম যুদ্ধ করতে করতে মরে যাব। তবুও মায়ের কথায় দেশ স্বাধীন করব। কাশিগঞ্জের যুদ্ধে বোমা মেরে ৭৫জন রাজাকারকে হত্যা করা হয় এক সঙ্গে, ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ। বোমা ছুটতে ছুটতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। সহকর্মীরা ভেবেছিল মারাই গেছে, হয়তো দেশের স্বাধীনতা দেখার জন্যই আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছেন। আমরা ১১ নং সেক্টর কমান্ডার পরিচালক হামিদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। -শেখ আবদুল আওয়াল, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ থেকে
×