ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জামায়াত বিষয়ে প্রশ্ন করায় ক্ষেপে যান ঐক্যফ্রন্ট আহ্বায়ক

‘খামোশ’-সাংবাদিককে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন ড. কামাল

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

 ‘খামোশ’-সাংবাদিককে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন ড. কামাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জামায়াতকে ক্ষমতায় আনতে তাদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করা আবার সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন- এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতাপশালীর মতো থামিয়ে দিতে ‘খামোশ’ বলে দেখে নেয়ার হুমকি। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামালের এহেন আচরণে বিস্ময় জেগেছে গোটা জাতির মনে। কারও মতে এর মধ্য দিয়ে ড. কামালের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পাকি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা পাকি সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে পূর্ণ সহযোগিতা করে। স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে কোনভাবে দমিয়ে রাখতে না পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে জামায়াত একীভূত হয় ওসব খুনী। এই হন্তারক রাজাকারদের সারাজীবন ঘৃণা করে এসেছেন ড. কামাল। এবার সেই রাজাকার, আলবদর স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় আনতে তার দল গণফোরাম তাদের সঙ্গেই জোট গড়েছে। শুরুতে জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেয়া হবে না উল্লেখ করলেও এখন জামায়াতই হয়ে উঠেছে জোটের অন্যতম শক্তি। জামায়াতের ২২ প্রার্থীকে বিএনপি আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দিয়েছে। এছাড়া তিন প্রার্থী বিদ্রোহী হিসেবে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। স্বাধীনতাবিরোধী এই শক্তিতে ক্ষমতায় আনতে ড. কামালের প্রচেষ্টায় সমগ্র জাতি বিস্মিত। অনেকেই বলছেন, ড. কামালের এই আচরণে তার অন্তরের চেতনা প্রকাশ হয়েছে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ড. কামাল বলেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে, লোভ-লালসা নিয়ে লুটপাট করছে, তাদের হাত থেকে দেশকে আমরা মুক্ত করবই। যত শক্তিধর হোক তারা, দেশের মালিক জনগণের কাছে তাদের নত হতে হবে, তাদের পরাজয় হবেই। সাংবাদিকরা এ সময় স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ড. কামাল বলেন, শহীদ মিনারে এসব বিষয়ে কোন কথা তিনি বলবেন না। এ সময় তিনি বারবার বলেন, শহীদদের কথা চিন্তা কর। শহীদদের কথা চিন্তা কর। এরপরও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে থাকেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তারপরও তারা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচন করছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে একপর্যায়ে ক্ষেপে যান ড. কামাল। তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। বেহুদা কথা বল। কত পয়সা পেয়েছ এসব প্রশ্ন করতে? কার কাছ থেকে পয়সা পেয়েছ? তোমার নাম কী? জেনে রাখব তোমাকে। চিনে রাখব। পয়সা পেয়ে শহীদ মিনারকে অশ্রদ্ধা কর তোমরা। আশ্চর্য! কী নাম তোমারÑ এক সাংবাদিকের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলে ওই সাংবাদিক বলেন, তিনি যমুনা টিভির সাংবাদিক। নাম হাসনাত। উত্তরে ড. কামাল বলেন, চিনে রাখলাম তোমাকে। পাশে থাকা দুই-একজন নেতা এ সময় ড. কামালকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আরেক সাংবাদিক এ সময় প্রশ্ন চালিয়ে গেলে ধমকে ওঠেন ড. কামাল। তিনি ফের বলেন, শহীদদের কথা চিন্তা কর। হে হে হে হে করছে! শহীদদের কথা চিন্তা কর। চুপ কর। চুপ কর। খামোশ। এর পর ড. কামাল শহীদ মিনার ত্যাগ করেন। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রথম দিকে মানুষের জনসমর্থন আদায় করতে ড. কামাল কোনভাবেই স্বাধীনতাবিরোধী কাউকে আশ্রয় দেয়া হবে না উল্লেখ করেছিলেন। জামায়াতকে এই জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে বিএনপিকে প্রধান শর্তও তাই দিয়েছিলেন ড. কামাল। কিন্তু পরে এসে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়তে না চাইলে ভোটের মাঠে জামায়াতই হয়ে ওঠে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শক্তি। জামায়াত প্রার্থীরা ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করলেও ড. কামাল প্রতিবাদ করেননি। সম্প্রতি মাহী বি চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেখানে মাহী উল্লেখ করেন ড. কামাল দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। ওই ফোনালাপে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ করেন মাহী চৌধুরী। মাহীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ না জানিয়ে চুপ থাকেন মান্না। অর্থাৎ এই চুপ থাকার মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতার পালাবদলে ভোটের চেয়ে একপক্ষের ষড়যন্ত্রই প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. কামাল ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। সারাদেশে ড. কামালের ও তার দলের তেমন কোন জনপ্রিয়তা নেই। গণফোরামের ’৯৬ থেকে ২০০৮ তিনটি নির্বাচনের ফলই বলে দেয় ড. কামালের দল কতটা জনপ্রিয়। ’৯৬ সালে গণফোরাম প্রথমবার দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। তখন ১০৩ আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল দলটি। ১০৩ আসনে ভোট পেয়েছিল ৫৪ হাজার ২৫০। অর্থাৎ আসনপ্রতি ৫২৬ ভোট পেয়েছিল দলটি। এরপরের দুটি নির্বাচনে আর এত বেশিসংখ্যক মানুষকে প্রার্থী হিসেবেও পায়নি দলটি। ২০০১ সালে ১৭ আসনে প্রার্থী দিয়ে গণফোরাম ৮ হাজার ৪৯৪ ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ সেবার আগেরবারের তুলনায় ভোট আরও কমে যায়। আসনপ্রতি গড় ভোটপ্রাপ্তি ছিল মাত্র ৪৯৯। ২০০৮-এ ফের নির্বাচনে ৩৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল গণফোরাম। সেবার অবশ্য ভোট বেশ খানিকটা বেড়েছিল। সেবার সারাদেশে ৭২ হাজার ৯১১ ভোট পেয়েছিল। তাও আসনপ্রতি দুই হাজার ভোট জোটেনি গণফোরাম প্রার্থীদের কপালে। আসনপ্রতি গড় ভোট ছিল ১ হাজার ৯১৯। অর্থাৎ মাত্র একটি আসনে জয়ের জন্য যত ভোট দরকার সারাদেশে গণফোরাম প্রার্থীরা সেই ভোটও পান না। জনপ্রিয়তার এই হাল নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসা কোনদিনই ড. কামাল বা তার দলের পক্ষে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর ড. কামাল বিএনপি-জামায়াতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে ঐক্যফ্রন্টের এই নেতা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সবাই ধারণা করেন, সকালের ব্যবহারের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ দূরের কথা সেই বক্তব্যর ধারেকাছেও যাননি তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল বলেন, বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। যেসব পুলিশ গ্রেফতার করছে, তারা কেন এসব করছে বলে প্রশ্ন তোলেন তিনি। জানতে চান, এদেশে কোন সংবিধান আছে? দেশে কোন সংবিধান আছে বলে তো মনে হয় না। আসলে তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সংবিধানকে উপহাসের বস্তু বানিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, জেনে রাখ, চিরদিন কেউ ক্ষমতায় থাকে না। আর কোন সরকারও আইনের উর্ধে নয়। এই সরকার আর ১৬ দিন ক্ষমতায় আছে। সুতরাং বেআইনী আদেশ মানবে না। নির্বাচনের আগেই ড. কামাল নির্বাচনের ফল বাতলে দিচ্ছেন। তিনি সরকারের মেয়াদ আর ১৬ দিন বলে উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাই এবার নির্বাচনে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে- এদেশ মুক্তিযুদ্ধের দেশ, এদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এই দেশে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হবে। আমরা আগামী নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধীদের অবশ্যই পরাজিত করব। এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
×