ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ দশক উদ্্যাপন অনুষ্ঠানে উদীচী

আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো আমরা যুদ্ধ আমরা আলো

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো আমরা যুদ্ধ আমরা আলো

মোরসালিন মিজান ॥ অভিনন্দন, উদীচী! বিরুদ্ধ স্রোত। অযুত বাধা। উঁচু নিচু পথ। সবই উপেক্ষা করে সামনের পানে ছোটা, এগিয়ে চলা। ৫০ বছর পূর্তি। দৃশ্যমান অর্জন কারও মতে অনেক হতে পারে। কেউ বলবেন, কম। বিভিন্ন সময় নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর কী ভাল, কী মন্দ, তা নিয়েও চুলছেড়া বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে দীর্ঘ পথচলার কৃতিত্ব সংগঠনটিকে দিতেই হবে। ‘যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,/যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়-/তবে পথের কাঁটা/ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে...।’ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রক্তমাখা চরণে এগিয়ে চলেছে। এভাবে পাঁচ দশক। এখন বর্ণাঢ্য আয়োজনে ঢাকায় উদ্যাপিত হচ্ছে সুবর্ণ জয়ন্তী। তিন দিনব্যাপী আয়োজনে যোগ দিয়েছেন সারা দেশ থেকে আসা শত শত কর্মী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন বিশিষ্টজনরা। জাতীয় ভিত্তিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও জানানো হচ্ছে শুভেচ্ছা। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। ইতিহাসটি স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। প্রাণ পুরুষ ছিলেন সত্যেন সেন। তার নেতৃত্বে প্রগতিশীল চিন্তার একদল কর্মী সংঘবদ্ধ হন। কাজ শুরু করেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে উদীচীর কর্মীরা। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে পাওয়া যায় তাদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, মৌলবাদমুক্ত, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করেন কর্মীরা। গণসঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, কবিতা, চলচ্চিত্রের ভাষায় সমাজ পরিবর্তনের দাবি তুলে ধরেন। তাদের ভাষায়Ñ আরশির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে/যদি ভাবি কোটি জনতার মুখ দেখব/হয় না হয় না হয় না/কে বলেছে হয় না এসো এই মঞ্চে/উদীচী এমনই এক আয়না...। এখন এ আয়নায় হাসিমুখ। উৎসবে মেতেছেন সবাই। ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় চলছে তিন দিনের অনুষ্ঠানমালা। শনিবার সকালে শহীদ মিনারে এর উদ্বোধন করা হয়। এবারের স্লোগানÑ আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো/আমরা যুদ্ধ আমরা আলো।’ স্লোগান থেকে পরিষ্কার, অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে চলা সংগ্রাম সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত রাখবে উদীচী। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পরিবেশনা থেকেও দেয়া হয় এ বার্তা। এদিন সকাল থেকেই উদীচী কর্মীদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে ওঠে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। শত শত কর্মী। ঢাকার যেমন, বাইরে থেকেও এসেছে বড় একটি অংশ। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী সংগঠকরা যোগ দিয়েছেন। ঢাকার জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও আসছে শুভেচ্ছা জানাতে। সব মিলিয়ে মিলনমেলার চেহারা। এদিন উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা কমরেড মনজুরুল আহসান খান। সভাপতিত্ব করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমেদ। ভারত থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার। বিভিন্ন সময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করা কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম ও অধ্যাপক পান্না কায়সার সম্মিলিতভাবে উদ্বোধনী ঘোষণা প্রদান করেন। এ সময় শান্তির প্রতীক হিসেবে এক ঝাঁক সাদা পায়রা আকাশে উড়িয়ে দেয়া হয়। উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। উদীচীর পতাকাও উড়ছিল পাশাপাশি। একসঙ্গে সবাই মিলে জাতীয় সঙ্গীত গান। হয় সংগঠন সঙ্গীতও। এভাবে বাংলা বাঙালী ও উদীচী যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছে। এই কাজে আমাদের সঙ্গে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও রয়েছে। উদীচী গত পঞ্চাশ বছরে এ জাতির প্রগতিধারার শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি ও মানবতার জন্য অবিরাম কাজ করে এসেছে। তিনি উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, এই সংগঠনটির মূল কর্ম হচ্ছে গণমানুষ। এ কারণে উদীচী কখনও মানুষের পক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজও পর্যন্ত সংগঠনটি গণমানুষের কাছে থেকেই কাজ করছে। পরের আয়োজনটি ছিল বর্ণাঢ্য। বহু সংখ্যক শিল্পী সঙ্গীত নৃত্য কবিতা অভিনয়ের ভাষায় উদীচীর গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরেন। টুকরো টুকরো উপস্থাপনা হলেও, উদীচীকে বুঝতে কষ্ট হয় না। চমৎকার উদ্বোধনী পরিবেশনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় ছিলেন শংকর সাওজাল। পরিবেশনাটি উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দেয়। পরে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয় শোভাযাত্রা। এখানেও বিশাল মঞ্চ। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় আলোচনাপর্ব। অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর এবং ফ্রান্সের প্যারিসের উবারভ্যালিয়ার্স-এর ডেপুটি মেয়র এ্যান্থনি দাগে। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিকাল ৪টায় পুনরায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। এ পর্বের শুরুতে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিরা উদীচীকে অভিনন্দন জানান। এ তালিকায় ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতি, কল্যাণ সেন বরাট, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, বিমল দে, বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী প্রমুখ। এরপর কল্যাণ সেন বরাটের শিল্পী জীবনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উদীচীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। সান্ধ্য আয়োজনটি আলোয় ভরিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন কল্যাণ সেন বরাট, শুভেন্দু মাইতি ও পূরবী মুখোপাধ্যায়। এই তিন শিল্পীর পরিবেশনা ঢাকার শ্রোতাদের জন্য দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এক ধরনের জাগরণী বার্তা দিতে সক্ষম হন তারা। পরে মঞ্চে ওঠে উদীচীর বিভিন্ন জেলা শাখার শিল্পীরা। বান্দরবান জেলা সংসদ আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করে। ময়মনসিংহ জেলা সংসদের পরিবেশন করে গীতি-নৃত্যনাট্য ‘সাদী মোবারক।’ যশোর জেলা সংসদের পরিবেশনায় ছিল ‘আরশির সামনে।’ গোপালগঞ্জ জেলা সংসদ পরিবেশন করে ‘নকশী কাঁথার মাঠ।’ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শাখার পরিবেশনাও উপভোগ করেন শ্রোতা। ছিল আবৃত্তির পরিবেশনাও। এদিন একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও রূপা চক্রবর্তী। আয়োজকরা জানান, আজ রবিবার ও আগামীকাল সোমবার একই রকম আয়োজনে মুখর থাকবে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। এর আগে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরের শুভক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে গত বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে বছরব্যাপী কর্মসূচী হাতে নেয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এরই সমাপনী আয়োজন এখন চলছে।
×