ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলুর আলোয় উদ্ভাসিত দেশের উত্তরাঞ্চল

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২ অক্টোবর ২০১৮

আলুর আলোয় উদ্ভাসিত দেশের উত্তরাঞ্চল

তাহমিন হক ববি, নীলফামারী থেকে ॥ ফসলের বহুমুখীকরণে দিন বদলেছে। বর্তমান সরকারের কৃষি বিপ্লবে উত্তরের মঙ্গা আজ অতীত। অভাব-অনটন না থাকার কারণ নেই। নেই না খেয়ে মরে যাওয়ার সেই দিন। ফসল উৎপাদনে কৃষক এখন দ্রুতযানে পরিণত হয়েছে। মধ্য আশ্বিন চলছে। কার্তিক আসতে আরও ১৫ দিন বাকি। এর মাঝে মঙ্গা বা অভাব তাড়ানোর আগাম চাষের আমন ধান ঘরে তুলেই আগাম আলু উৎপাদনের সুঁতিকাগার নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় আগাম আলু বুনতে শুরু করেছে কৃষককুল। আগাম আমন ধানের পর আগাম আলু যেন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলছে উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলকে। এ অঞ্চলে কৃষকরা এখন কোন জমি আর পতিত ফেলে রাখেন না। এক সময় মঙ্গা নামক এক দুঃসহ কাল কাটাতেন তারা। ফসল নেই, কাজ নেই, নেই খাবার। সেই মঙ্গাকে তাড়িয়ে দিয়েছে আগাম ধান। আগাম ও স্বল্পমেয়াদী জাতের আমন ধান কর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকরা আলু রোপণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। একদিকে চলছে ধানকর্তন, অন্যদিকে চলছে আলু রোপণ। ফসল উৎপাদন যেন মহাবিপ্লবে পরিণত হয়েছে। ক’দিন আগে বিভিন্ন আগাম জাতের আমনের হাইব্রিট ধান জমি হতে কেটেছে কৃষক। সেই জমিতে এখন আগাম আলুর বীজ বুনছে। গত বছরের ভাল ফলন তাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে। ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে বাজারে আসবে এই আলু। ফসলের মাঠে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের বসে থাকার সময় নেই কৃষি শ্রমিকদেরও পোয়া বারো। তাই আগাম জাতের আলু চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জের কৃষকরা। আগাম আলু আবাদে লাভ হওয়ায় কৃষকরা কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছেন। উপজেলার উঁচু ও ডাঙ্গা সব জমিতেই বর্তমানে আলু চাষের কাজ চলছে। কেউ জমি তৈরি করছেন, কেউবা শ্রমিক নিয়ে খেতে আলু লাগাচ্ছেন। মাগুরা ইউনিয়নের কৃষক সাবেদ আলী জানান, বিঘা প্রতি জমিতে আগাম জাতের আলু রোপণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। বিঘায় আলু উৎপাদন হবে প্রায় আড়াই হাজার কেজি। আগাম আবাদে আগাম বাজার ধরতে পারলে আলুর কেজি বিক্রি হবে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এতে বিঘা প্রতি আলু বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে লাভ পাওয়া যাবে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাছাড়া ৫০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে আলু জমি থেকে তোলা যায় বলে এ আলু চাষে কৃষকদের আগ্রহ বেশি। উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব দলিরাম গ্রামের কৃষি শ্রমিক শাহজাহান আলী জানান, আগে বেকার থাকতে হতো আর এখন আলু খেতে কাজ করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা মজুরি পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ সূত্র মতে চলতি বছরে এখনও আলু উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে গত বছরের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে অচিরেই আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হবে। যদিও গেল মৌসুমে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয় নীলফামারী জেলায়। এরমধ্যে আগাম জাতের আলু চাষ করা হয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার হয়ত এটি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাজারে যার আলু যত আগে উঠবে, তার লাভ তত বেশি। জানালেন কিশোরীগঞ্জ উপজেলার উত্তর দুরাকুটি গ্রামের আলু চাষী আলম হোসেন। গতবার তিনি ৮ বিঘা জমিতে আগাম আলু আবাদ করে দ্বিগুণ লাখের মুখ দেখেছেন। এবার ১২ বিঘা জমিতে আলু বুনছেন। তিনি জানান আবহাওয়া অনুকূল, বীজের দাম কম। প্রয়োজনীয় সারের সরবরাহও স্বাভাবিক। সব মিলে ফসল উৎপাদনে আমরা কৃষককুল দিন দিন দ্রুতযানের মতো এগিয়ে যাচ্ছি। এই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ কর্মব্যস্ত কৃষক, কিষান ও কিষাণীরা। জিয়ারুল, শাবুল, বেলাল, টিটো, জহুরুল, খোকন, মানিক, প্রতিমা রায়, গোলাপী রানী , রঞ্জিতা রাণী, রঞ্জিত এবং আরও অনেকেই আলু বুননের কাজ করছেন আনন্দ নিয়ে। পারিশ্রমিক পাচ্ছেন দিনে ৪০০ টাকা।বাড়ি ফিরে সন্তানের ক্ষুধার্ত চোখ দেখতে হয় না। দশ বছর আগের সেই মঙ্গা আর অভাবের কথা তারা আর মনে করতে চাননা। কৃষি শ্রমিকরা বললেন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকলে কৃষি ভাল হয়। এ যেন ধন্যি রাজার পূর্ণির দেশ দেখতে পাই। আগের সরকার যখন ছিল(বিএনপি) তখন সার পাওয়া যেত না। ফলে জমি পতিত পড়ে থাকত। এখন ফসল আবাদে সার সঙ্কট নেই। জমিতে যত ফসল আবাদ হবে কামলাদের তত কাজ থাকবে। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার নিতাই ইউনিয়নের গাংবের গ্রামের আলুচাষী আবুল কালাম আজাদ জানালেন আগাম জাতের আমন ধান আবাদ করে ঘরে তুলে সেই জমিতেই আলু আবাদ শুরু করেছি। ফলন নিয়ে খুব আশাবাদী পানিয়ালপুকুর এলাকার আলুচাষী মোরছলিন। তিনি গতবার পাঁচ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করলেও এবার দ্বিগুণ করছেন। একই উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের আলুচাষী রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কৃষকরা সেভেন ও গ্রানুলা জাতের আলুই বেশি লাগাচ্ছে। এটির ফলন ভাল হয়। এখান কৃষক আগাম জাতের আমন ধান কাটাই মাড়াই শেষে তা বাজারে বিক্রির টাকা দিয়েই আলু আবাদের খরচ বহন করছেন। বেড়াডাঙ্গার কৃষক কামরুজ্জামান ১৭ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করছেন। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার দুরাকুটি পুটিমারী, কালিকাপুর ও পানিয়ালপুকুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অন্য রকম এক দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু আলু আবাদ চলছে। কিশোরীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, আগাম আলু আবাদের জন্য আবহাওয়া অনুকূল রয়েছে।
×