ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা বাণিজ্য ॥ বিভ্রান্তিকর রিপোর্টে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রোগী

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা বাণিজ্য ॥ বিভ্রান্তিকর রিপোর্টে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রোগী

নিখিল মানখিন ॥ একই রোগ, পরীক্ষাও একই। তাতে তিন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফলাফল তিন রকম। মিল নেই একটির সঙ্গে অন্যটির। এতে দু’ বছরে রোগ নির্ণয়তো হয়নি, উল্টো নানা ওষুধ সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ময়মনসিংহের বাঘাইতলা গ্রামের মোঃ খলিল মিয়া (৩৯)। তিনি পরীক্ষাগুলো করিয়েছেন গাজীপুরের টঙ্গীর হেনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাবর রোডের সোহান ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও উত্তরার মুক্তি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। শুধু মোঃ খলিল মিয়া নন, এমন বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের ভিত্তিতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে গিয়ে অনেক রোগীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্টের অভাবে রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয়ের সঠিক রিপোর্ট পাচ্ছেন না। পাশাপাশি অনেক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসক না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ টেকনিশিয়ান ও নন মেডিক্যাল কর্মচারীরা পরীক্ষার কাজ করে থাকেন। আর অনেক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি পর্যন্ত নেই। সরকারী হাসপাতালে রিপোর্ট করিয়ে তা নিজেদের নামে চালিয়ে রেকর্ড সংখ্যক বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারী অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগের পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে তুলে ধরা হয় মেয়েলি রোগের বিবরণ। আবার উল্টো চিত্রও আছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট প্রতিষ্ঠানের দর্শনীয় স্থানে লাগিয়ে রাখার। কেউ সে নিয়ম মানছে না। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। রোগী আকর্ষণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় বিশেষজ্ঞদের তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও তাদের অধিকাংশকেই পাওয়া যায় না। নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেয়া হয় ওইসব ডাক্তারকে। ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠা-া, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্টের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৫০ ভাগ ‘ভর্তি ফি’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে যায়। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০ বেসরকারী ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে র‌্যাবের মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছে। এদিকে, বিশেষজ্ঞ ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্টের অভাবে রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয়ের সঠিক রিপোর্ট পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
×