ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের অত্যাচার নির্যাতন

সুচির নীরবতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  সুচির নীরবতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা  নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য এক মূর্তিমান উৎপাত আউং সান সুচি। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর এনএলডি নেত্রী সুচি রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব থাকায় দেশটির সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের অত্যাচার, গণহারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি নির্যাতনের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। জানা যায়, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যথেষ্ট সমবেদনা দেখালেও রোহিঙ্গাদের বেলায় তেমন কার্যকর ভূমিকা কেউই নিচ্ছে না। সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে। যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে ধরছে, আর যেভাবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই দ্রুত জনবর্ধনশীল দেশের কী অবস্থা হবে, এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সমবেদনা জানানো দেশগুলো তাদের জন্য সাহায্য সহায়তা দিচ্ছে ঠিকই, তবে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ প্রয়োগ করলে হয়ত শীঘ্রই ফিরে যেতে পারত রোহিঙ্গারা। এতে দেশ ও দেশের মানুষ লাখে লাখে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার বোঝা থেকে মুক্ত হতো। সূত্র জানায়, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সবকিছু স্বীকার করে গেলেও বাস্তবে কিছুই করে না। ওপারে বসবাসকারী রাখাইন যুবকরা আউং সান সুচির ৬ বছর আগে দেয়া একটি বক্তব্যের অনুকরণে পোস্টারিং করেছে। দেশটির বিভিন্ন শহর ও শহরতলীতে ওসব পোস্টার ও ব্যানার টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। আউং সান সুচির ৬ বছর আগে দেয়া ওই বক্তব্যের লাইনটি ব্যানার-ফেস্টুনে লিখে মিছিল ও পথসভা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সেøাগান দেয়া হয়ে থাকে ওসব মিছিলে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে এক সাক্ষাতকারে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নেতা আউং সান সুচি বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী মনে করা যায় কি না, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। ওই মন্তব্যের পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায় রোহিঙ্গারা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত আউং সান সুচি বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েও তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে একদম চুপ। রোহিঙ্গাদের ওপর অন্যায়-অবিচার চালানো সত্ত্বেও তিনি হাত মিলিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে। সূত্রে প্রকাশ, মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা প্রয়াত আউং সান এর কন্যা বিদেশে অবস্থানরত আউং সান সুচি অসুস্থ মাকে দেখতে ১৯৮৮ সালে দেশে আসেন। সময়ের প্রয়োজনে তিনি রাজনীতিতে পা রেখে সমমনাদের নিয়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) গঠন করেন। ওই সময় এনএলডি দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে মিয়ানমার সামরিক সরকার বহুদলীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা প্রয়াত আউং সানের অবদান স্মরণ করে তার কন্যাকে সমর্থন দেয় দেশের মানুষ। ১৯৯০ সালের ২৭ মের নির্বাচনে সুচির দল শতকরা ৮২ ভাগ ভোট পেয়ে জয়ী হয়। কিন্তু সামরিক সরকার সে ফল গোপন রেখে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে সুচির জনপ্রিয়তা টের পেয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের ১৫ বছরই সুচির বিভিন্ন সময়ে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটে। এদিকে সুচিকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া হলে হয়ত রোহিঙ্গাদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখবেন বলে আশায় বুক বাঁধে রোহিঙ্গারা। তখন দেশটিতে নাগরিকত্বসহ সমান অধিকার নিয়ে দিনযাপন করতে পারবে তারা। ২০০৯ সালে আসিয়ান সামিটে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সুচির মুক্তির ওপর বিশেষ জোর দেন। আমেরিকা ও ব্রিটেন উভয়ই মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের ওপর জোর দিতে থাকে। ২০১০ সালে সুচি মুক্তি পান। ২০১২ সালে সাধারণ নির্বাচনে আউং সান সুচি ও তার দল (এনএলডি) বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণ করে। ২০১২ সালের ৯ মে সুচি প্রথম আইনপ্রণেতা হিসেবে দেশটির পার্লামেন্টে উপস্থিত হন। ছয় দশকের রক্তপাত ও সশস্ত্র সংঘাত এবং একনায়কতন্ত্রের পর মিয়ানমার গণতন্ত্রের মুখ দেখলেও কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়নি। বন্ধ হয়নি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতির ওপর অত্যাচার নিপীড়ন। আউং সান সুচির প্রথম বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত ভাবা শুরু হয়। উপায়ান্তর না দেখে সেখানে শান্তিতে বসবাস ও ব্যবসাবাণিজ্য করার লক্ষ্যে কিছু রোহিঙ্গা সরকারী বাহিনীর সোর্স (রোহিঙ্গা ভাষায় থাব্যে) হিসেবে কাজ করা শুরু করে। তারাই মূলত সেখানে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পৌঁছায় সরকারী বাহিনীর কাছে। পরবর্তীতে পাড়া ঘিরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ওসব রোহিঙ্গাকে। জানা যায়, ২০১২ সালে আউং সান সুচির রোহিঙ্গা বিরোধী বক্তব্যের পর নিরাশ হয়ে পড়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা। এ সময় সুযোগটি হাতছাড়া না করে মিয়ানমারে স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে গঠিত আরএসও এবং আরসাসহ একাধিক রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠে মিয়ানমারের বাইরে থাকা আরাকান বিদ্রোহী জঙ্গীরা। রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তারা দফায় দফায় বৈঠকে বসে বিদেশের মাটিতে। রোহিঙ্গা জঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে আরসার মূল নায়ক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আতা উল্লাহর নেতৃত্বে ৪০ রোহিঙ্গা জঙ্গীকে মিয়ানমারে পাঠায়। রোহিঙ্গা জঙ্গীদের উদ্দেশ্য ছিল, সরকারকে উস্কে দিলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে রোহিঙ্গাদের ওপর। রোহিঙ্গারা দেশ থেকে বিতাড়িত হলে বিদেশী তথা আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার সরকার। এ সিদ্ধান্তের অনুকূলে ২০১২ সালে মিয়ানমারে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায় আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ। ওই সময় তেমন উত্তপ্ত হয়নি মিয়ানমার। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাতে মংডুর তিনটি নিরাপত্তা ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলে পড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। হত্যা করে নিরাপত্তা চৌকিতে দায়িত্বরত সাত পুলিশ সদস্যকে। লুটে নিয়ে যায় ওসব চৌকির অস্ত্রশস্ত্র। দেশটির সেনাবাহিনী ১০ অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় একাধিক ঘরবাড়ি। ধরপাকড় শুরু হলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসে সীমান্ত এলাকায়। তবে বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ থাকায় বিজিবি-কোস্টগার্ড ওসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করতে দেয়নি। তারপরও চোরাইপথে ওই সময় অন্তত দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও উখিয়া টেকনাফে বস্তি তৈরি করে আশ্রয় নেয়।
×