ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরেণ্য শিল্পী দম্পতি বুলবুল-ময়না

প্রকাশিত: ০৭:২২, ৯ আগস্ট ২০১৮

বরেণ্য শিল্পী দম্পতি বুলবুল-ময়না

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বুলবুল ইসলাম। বর্তমানে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। শারমিন সাথী ইসলাম ময়না, নজরুলসঙ্গীত শিল্পী, শিক্ষক ‘ছায়ানট’। গত ৬ আগস্ট ছিল এই শিল্পী দম্পতির ২৫তম বিবাহবার্ষিকী। আনন্দকণ্ঠে এবার থাকছে তাদের যুগল পথচলার গল্প, জানাচ্ছেন -পপি দেবী থাপা আনন্দকণ্ঠ : আপনাদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় এবং পথচলার গল্প... বুলবুল : ময়না যদিও নজরুলসঙ্গীত করে তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতও ভাল গায়। ওকে আমি প্রথম দেখি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের অনুষ্ঠানে। এটা ছিল ১৯৯১ সাল। ও তখন ছোট। পরের বছর আবার দেখা একই অনুষ্ঠানে। তখন শুধুই দেখা। ময়না : এরপর ঢাকায় পড়তে এলাম। গান শেখার জন আনন্দধ্বনিতে ভর্তি হলাম। আসলে আমাদের যোগ সূত্রের প্রধান মানুষটি হলেন ওয়াহিদুল হক। উনিই আমাকে প্রথম ঢাকায় নিয়ে আসেন। বুলবুল তখন আনন্দধ্বনির সিনিয়র কর্ণধারদের একজন। আমি মাত্র ঢুকেছি। পরিচয় সেখানেই। শুরু হয় আলাপচারিতা এবং তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর মন দেয়া নেয়া। অবশেষে দুই হৃদয়ের ভালবাসার সুতোর টান আমাদেরকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে ১৯৯৩ সালের ৬ আগস্ট। আনন্দকণ্ঠ : গান গাইবার ক্ষেত্রে একে অপরকে কিভাবে সহযোগিতা এবং সমর্থন করেন? বুলবুল : আমরা দুই পক্ষই একে অপরের গান নিয়ে কনসার্ন। ও নজরুলসঙ্গীত গাইলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বোঝে ভাল এবং আমার গানের প্রতি সব সময় খেয়াল কেেকান অনুষ্ঠানে গান গাইবার সময় আমার প্রথম চিন্তা থাকে গানটি বুলবুলের কেমন লাগল। আমি গান গাইবার মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে ওর চেহারার এক্সপ্রেশন বোঝার চেষ্টা করি। যদি দেখি ওর চেহারা একটু খারাপ দেখাচ্ছে, মুখটা অন্ধকার, বুঝতে পারি আমার গান ভাল হচ্ছে না। আবার যখন ওর চেহারাটা হাসি-খুশি থাকে তখন বুঝি, গান ভাল হচ্ছে। আমার কাছে বুলবুলের ভাল লাগাটাই হলো প্রধান। অবশ্য ওকে আমি খুব বেশি ধরিয়ে দিতে পারি না। দুজনেরই একে অপরের প্রতি চেষ্টা থাকে যে ওর গানটা যেন ভাল হয়। আবার দুজন, দুজনের গানের খুব বড় সমালোচক। ময়না : কোন অনুষ্ঠানে গান গাইবার সময় আমার প্রথম চিন্তা থাকে গানটি বুলবুলের কেমন লাগল। আমি গান গাইবার মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে ওর চেহারার এক্সপ্রেশন বোঝার চেষ্টা করি। যদি দেখি ওর চেহারা একটু খারাপ দেখাচ্ছে, মুখটা অন্ধকার, বুঝতে পারি আমার গান ভাল হচ্ছে না। আবার যখন ওর চেহারাটা হাসি-খুশি থাকে তখন বুঝি, গান ভাল হচ্ছে। আমার কাছে বুলবুলের ভাল লাগাটাই হলো প্রধান। আনন্দকণ্ঠ : নজরুলের রবীন্দ্র প্রীতি নিয়ে যদি কিছু বলেন... ময়না : বর্তমানে যারা ওনাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কে দ্বার করিয়ে দিচ্ছে তাদের বুঝতে হবে তারা দুজন তো দুই জেনারেশনের। নজরুল ওনার ছেলেরও ছোট। অসাধারণ স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে। ওনাদের শিল্পকর্ম এবং জীবনী পড়লে এ ভ্রান্ত বিষয়গুলো দূর হবে। নজরুলের জায়গা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জায়গা তো এক না। নজরুল তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। এমনকি এক সময় তিনি রবি ঠাকুরের গান ছাড়া অন্য গান গাইতেন না। বুলবুল : রবীন্দ্রনাথও ভীষণ রকমের স্নেহ করতেন তাঁকে। একটা ঘটনা আছে, নজরুলের একটা সিনেমার গান বিশ্বভারতী আটকে দিয়েছিল। যে সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। তিনি নিজেই চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। নজরুল আসছে এ কথা শুনেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘নজরুল যেটা করেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না।’ এটা তো ভালবাসার প্রশ্রয় ছাড়া আর কিছু নয়। আনন্দকণ্ঠ : বর্তমান সমাজে মানবতার অবক্ষয় রোধে রবীন্দ্র এবং নজরুলসঙ্গীত কিভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে? বুলবুল : রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মাঝে, মানবতার বিষয় রয়েছে। সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমস্ত কিছু মিলে ভীষণ রকমের একজন মানবিক মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমি মনে করি এই দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের অনেক বেশি ধারণ করা দরকার। অনেক বেশি মানবিক হওয়া দরকার। সেই শিক্ষা আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে, নজরুলের কাছ থেকে নিতে পারি। নজরুল সারাটি জীবন মানবতার জয়গান গেয়েছেন। জাতি ধর্ম, বর্ণের উর্ধে থেকে সাম্যের কথা বলেছেন। রবীন্দ্র, নজরুলের দর্শন সামনে রেখেই আমাদের চলতে হবে। আনন্দকণ্ঠ : আপনাদের কর্মময় জীবনকে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে অনুপ্রাণিত করে? ময়না : ওঁনাকে ছাড়া আমরা ভাবতে পারি না। জীবন চলার প্রতিটি কার্যেই তিনি যেন উৎসাহ, প্রেরণা, উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগান। কি আনন্দ, কি বেদনায় সব-সময়ই তো তিনি আছেন সঙ্গে। বুলবুল : কিছু ভাল লাগলে তা রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়েই ভাল লাগাই। আবার যখন খারাপ লাগে সেই খারাপ লাগাটাও তাঁর গানের ভেতর দিয়েই নিজেকে জানাই। তাঁর বিচরণটা এত ব্যাপক যে, সমস্ত কিছুতেই তিনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যে সকল বিজয় অথবা শোকের কিবা দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে সমস্ত কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে, সাহস দিয়ে সঠিক গন্তব্যের দিশা দেখিয়ে যাচ্ছেন। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রনাথের এবং নজরুলের গানের সুরের বিকৃতি নিয়ে আপনাদের মতামত... বুলবুল : হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের গান কেউ কেউ বিকৃত করছেন, কিন্তু সে বিকৃত সুরগুলো থাকছে না। আলটিমেটলি সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তা সমাজে স্থায়ী হচ্ছে না। বেটোফেনকে কি পরিবর্তন করা যাবে মেজার্টকে কি পরিবর্তন করা যাবে? যাবে না। রবীন্দ্রনাথকে পরিবর্তন করার ধৃষ্টতা না দেখানোই ভাল। যার সৃষ্টি তার মতোই রাখতে হয়। তোমরা যদি আরও উন্নত ভাবনা থাকে, অন্য রকম কিছু করতে চাও, তাহলে তা তুমি নিজে সৃষ্টি কর। আমাদের সামনে দাও। ভাল হলে সবাই সেটা গ্রহণ করবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তুমি ভাঙ্গতে পার না। তাহলে তা আর রবীন্দ্রনাথ থাকে না অন্য কিছু হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও চাইতেন না তাঁর গানের সুর বিকৃত হোক। তিনি নিজে লিখেছেন, সুর করেছেন, স্বরলিপি তৈরি করেছেন এবং তা যাতে স্থায়ী হয় সেজন্য সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর শিষ্যদের তা শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে সব কাজ করে রেখে গেছেন। ময়না : নজরুলও তাঁর গানের বিকৃত সুরের বিষয়ে জোড়াল প্রতিবাদ করেছেন। কেউ তো, তার সৃষ্টি ধ্বংস হোক এটা চাইবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ আমার গান যদি পছন্দ না হয় গেও না।’ আনন্দকণ্ঠ : কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? বুলবুল : সেক্যুলার বাংলাদেশ দেখতে চাই। শোষণমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চাই।
×