ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

মে মাসে বিনিয়োগ ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৪ জুলাই ২০১৮

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন ইয়াসমিন সুলতানা, স্বামী মালয়েশিয়াতে চাকরি করেন। সেখান থেকে যে টাকা পাঠান তা দিয়ে বাসা ভাড়া, ছেলের লেখাপড়া এবং অন্যান্য খরচ মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা সঞ্চয় করেন। জমানো সেই টাকা দিয়ে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন ইয়াসমিন। নিজের নামে কেনা সঞ্চয়পত্রের তিন মাস অন্তর মুনাফা তুলতে সোমবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছিলেন তিনি। তার মতো এমন অনেকেই এসেছেন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে। এর চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রেতাকে দেখা গেল সঞ্চয়পত্র কিনতে। দেখা গেল, সঞ্চয়পত্র কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন। রীতিমতো হিড়িক লেগেছে সঞ্চয়পত্র কিনতে। বিক্রিতেও সর্বকালের রেকর্ড গড়েছে সঞ্চয়পত্র। গত মে মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার। জানা গেছে, সমাজের অবসরপ্রাপ্ত, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা তথা যেসব ব্যক্তির বাণিজ্যিক বিনিয়োগ করার সক্ষমতা নেই, তাদের নিরাপদ উপার্জনের কথা চিন্তা করে সঞ্চয়পত্র চালু করে সরকার। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর মাধ্যমে সমাজের কিছু ব্যক্তির নিরাপদ বিনিয়োগের ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবেও কাজ করে। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণের চাপ কমলেও বাড়ছে সুদজনিত ব্যয়। ব্যাংক আমানতের চেয়ে দ্বিগুণ সুদ থাকায় প্রতি মাসেই বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত মে মাসে মোট ১০ হাজার ৯৩০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধ করে নিট ঋণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। যা দেশের সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এর আগে এক মাস হিসেবে সঞ্চয়পত্রের নিট ঋণের রেকর্ড ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে এ খাতের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট বিনিয়োগ এসেছে ৪৭ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। তবে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার। এর মধ্যে থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল্য ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ২৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। জানা গেছে, ব্যাংক আমানতের সুদহারের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের স্কিমগুলোর মুনাফার হার বেশি হওয়ায় তা কমানোর দাবি আসে ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে। এর ধারাবাহিকায় গত ৮ জুন বাজেট প্রস্তাব পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার সবসময় একরকম থাকবে এমন না। এটা দুই-তিন বছর পরপরই পর্যালোচনা করা হয়। এবার এটা পর্যালোচনা করতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বাজেটের মাসে অথবা পরের মাসে এটি পর্যালোচনা করা হবে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর আভাসের পাশাপাশি নতুন সঙ্কট এসে উপস্থিত হয়েছে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনা। গত ২০ জুন ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে তিন মাস মেয়াদী আমানতের সুদের হার কমিয়ে সর্বনিম্ন ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। যা গত সোমবার থেকে কার্যকর করেছে ব্যাংকগুলো। এসব হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতের সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। তবে সামনের দিনগুলোতে সুদের হার কমিয়ে আনা হলে বিক্রিও কমে আসবে বলে তিনি জানান। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে একটু বেশি লাভের আশায় সবাই ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত। তিনি বলেন, সুদের হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে এখনও অন্য যে কোন স্কিম থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়, সে কারণেই বিক্রি বাড়ছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে সরকার। এ হার ১১.৭৬ শতাংশ। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সশস্ত্র বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা। এতে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ‘পরিবার সঞ্চয়পত্রে’। এতে সুদের হার ১১.৫২ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্ক যে কোন নারী এই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। পাঁচ বছর মেয়াদী ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র দেশের যে কোন নাগরিক কিনতে পারেন। একক নামে ৩০ লাখ ও যৌথ নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে এই দুই সঞ্চয়পত্রে। এ ছাড়া ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ৭৭৩ কোটি টাকা নিট ঋণ আসায় পরবর্তী অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে উলম্ফন দেখা যায়। আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়তে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ হয়েছিল ২৮ ৭৭৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতের নিট ঋণ হয় ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ হয়েছিল ৪২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসে সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণের রেকর্ড। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে সরকারের ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়ার কথা রয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসর মধ্যে আগে বেশি ঋণ আসত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। সাম্প্রতিককালে বেশি ঋণ আসছে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে। ব্যাংকবহির্ভূত খাতের প্রধান উৎস সঞ্চয়পত্র। এছাড়া ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতেও ঋণ নেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ এবং সরকারী ঋণ ব্যবস্থাপনা শাখার তত্ত্বাবধানে নেশনওয়াইড এনএসডি বেনিফিশারি সার্ভে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের ৮০ শতাংশ শহরের বাসিন্দা। বিনিয়োগকারীদের অবস্থানের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে- বিভাগীয় শহরে ৬৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, জেলা ও উপজেলা শহরে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
×