ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪ ব্যর্থ প্রকল্প নিয়ে চলছে সিটি কর্পোরেশন ॥ দফায় দফায় পুনঃ অর্থায়ন করা হচ্ছে অধিকাংশ প্রকল্পেই

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৩ জুন ২০১৮

  ৪ ব্যর্থ প্রকল্প নিয়ে চলছে  সিটি কর্পোরেশন ॥ দফায় দফায় পুনঃ অর্থায়ন করা হচ্ছে অধিকাংশ প্রকল্পেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিচ্ছন্ন নগর গড়ার পাশাপাশি সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখেনি প্রকল্পগুলো। এসব প্রকল্পের মধ্যে রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন, রাস্তাঘাট বর্জ্যমুক্ত রাখতে ফুটপাতে মিনি ডাস্টবিন স্থাপন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অ্যানালগ পদ্ধতির সিগন্যালের পরিবর্তে কাউন্টডাউন টাইমার স্থাপন অন্যতম। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছিল, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এরপরও দফায় দফায় পুনঃ অর্থায়ন করা হচ্ছে অধিকাংশ প্রকল্পেই। মিনি ডাস্টবিন: পরিচ্ছন্ন নগরীর প্রত্যাশায় পৃথক দুই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর সড়কজুড়ে মিনি ডাস্টবিন স্থাপন করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ)। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই অধিকাংশ বিন চুরি ও নষ্ট হয়ে যায়। সচল বিনগুলোও তেমন কাজে আসছে না। সম্প্রতি সরেজমিন কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিনে বর্জ্যই ফেলেন না নগরবাসী। আবার কিছু কিছু বিনে বর্জ্য ফেলা হয়, তবে তা পরিষ্কার করা হয় না। মিনি ডাস্টবিনের এই প্রকল্প ব্যর্থ হলেও নষ্ট হওয়া বিন ঠিক করতে বেশ কয়েকবার অর্থ খরচ করছে দুই নগরভবন। জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) পাঁচ হাজার সাতশটি এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও (ডিএনসিসি) পাঁচ হাজারের বেশি মিনি ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়। বলা হয়েছিল, সুফল পেলে আরও বিন স্থাপন করা হবে। কিন্তু বিনগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হয়নি নগরবাসী। তবু এগুলোর পেছনে অর্থব্যয় থেমে নেই। ডাস্টবিনগুলো কয়েকবার সংস্কার ও চুরি হওয়ায় পুনঃ স্থাপন করা হয়েছে। ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির ভা-ার সূত্রে জানা গেছে, মিনি ডাস্টবিনের দুই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এ পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ অন্তত ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ অবস্থায় ইউনিসেফের সহায়তায় দুই সিটির বস্তি এলাকাগুলোতে নতুন করে আরও ২০ হাজার বিন দেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, ‘মিনি ডাস্টবিনে সফলতা নেই, এটা বলা যাবে না। নগরবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমরা চাচ্ছি মানুষ অভ্যস্ত হোক। এ জন্য বারবার অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।’ ফুট ওভারব্রিজ: রাস্তা পারাপারে দুর্ঘটনা এড়াতে ২০১৪ সালে রাজধানীর বনানী ও বিমানবন্দরের সামনের সড়কে দুটি ফুট ওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের দেড় মাসের মধ্যেই বনানীর সিঁড়িটি অকেজো হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৩ বার বিকল হয়েছে সিঁড়িটি। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, সিঁড়িটি মেরামতে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা। একই অবস্থা বিমানবন্দরের সামনের সড়কে স্থাপিত সিঁড়িটিরও। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, এতে খরচ হয়েছে প্রায় চার কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মল বায়ু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের (কেইস) আওতায় নির্মিত এই প্রকল্পটিতে সফলতা না এলেও পরে আরও সাতটি ফুটওভার ব্রিজে এই চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয়ে প্রায় ১১ কোটি টাকা। তখন বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বনানীর চলন্ত সিঁড়ি ঠিকভাবে চললে বাকিগুলো নির্মাণ করা হবে। এখন এ অবস্থায় দাতা সংস্থার সাড়া না পেয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নগরীর বিভিন্ন এলাকার সাতটি ফুট ওভারব্রিজে সিঁড়িসহ লিফট সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৩ কোটি টাকা। ফুট ওভারব্রিজ প্রকল্পের সাফল্য না পাওয়ার কথা স্বীকার করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (টিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মোল্লা মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, ‘ফুটওভার ব্রিজের চলন্ত সিঁড়িগুলো বারবার বিকল হয়ে পড়ছে। এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা।’ ফুট ওভারব্রিজ প্রকল্পে বারবার ব্যর্থ হওয়ার কারণে হাতে নেয়া লিফট প্রকল্প সম্পর্কে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বলেন, ‘চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্মাণের পরবর্তী তিন বছর এসব লিফট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়বদ্ধ থাকবে। এ জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জামানত রাখতে হবে। তিন বছর পর সিটি কর্পোরেশন পুরো দায়িত্ব বুঝে পেলে তা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগ দেয়া হবে।’ কাউন্টডাউন টাইমার: ঢাকার রাস্তায় অসহনীয় যানজট কমাতে ট্রাফিক সিগন্যাল ইন্টারসেকশনে ‘কাউন্টডাউন টাইমার’ বসায় দুই সিটি কর্পোরেশন। সড়কে ট্রাফিক মোবিলিটি অন্তত ১০ ভাগ বাড়ানো, ঢাকা মহানগরীর বায়ুদূষণ হ্রাসসহ ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দুই দফায় বাস্তবায়ন করা এই প্রকল্পটির প্রথম ধাপে ৭০টি সড়ক মোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসাতে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। পুরো প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩০৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটির উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও ভেঙ্গে পড়ে। শহরে দেখা দেয় ভয়াবহ যানজট। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কিছু সময় পরই কাউন্টডাউন বন্ধ করে আগের মতো হাত দিয়ে সিগন্যাল ব্যবস্থায় ফিরে যায় ট্রাফিক পুলিশ। পরে ২০১০ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটির দ্বিতীয় দফায় অর্থায়ন করা হয়। ২০১৪ সালের জুনে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সফলতা পায়নি নগরবাসী। পুরো প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পটির পরিচালক সেহাব উল্লাহর বিরুদ্ধে কানাডার নাগরিকত্ব ও একইসঙ্গে তিনটি পাসপোর্ট ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। ফগার মেশিন: না কেনার সুপারিশ সত্বেও মশা মারার জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ফগার মেশিন কেনা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন বলছে, এই যন্ত্রটি দিয়ে মশা মারা যাচ্ছে না। কারণ, এর শব্দ শুনেই মশা পালিয়ে তিন-চারতলা পর্যন্ত ওপরে উঠে যায়। তাছাড়া, কোটি টাকা দামের এসব যন্ত্র কয়েক দিনের মাথায় নষ্ট হয়ে পড়ে। পরিচালনার সময় আগুন ধরে যাওয়ার ঘটনাও আছে। এ অবস্থায় ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এই যন্ত্রগুলো না কেনার জন্য পরামর্শ দেয়া হলেও সম্প্রতি সংস্থার ভা-ার বিভাগ থেকে আবারও ৬০টি ফগার মেশিন এবং ৩০০টি হস্তচালিত মেশিন কেনা হয়। ডিএসসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ফগার মেশিন ক্রয় কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ শেখ সালাহ্উদ্দীন একটি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা বাস্তবতার নিরিখে এই মেশিনগুলো না কেনার জন্য একটা নোট দিয়েছি। কিন্তু ভান্ডার বিভাগ কী করেছে তা আমি জানি না। মেশিন কেনার কমিটির সদস্য হলেও এখন পর্যন্ত আমার নলেজে কিছুই আসেনি। এমন যদি হয়ে থাকে তা অবশ্যই আমি দেখব।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্র্র্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যদি এমন হয়ে থাকে, তা অবশ্যই অর্থের অপচয়। কোনও প্রকল্প থেকে সাফল্য না এলে পুনরায় অর্থব্যয় করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সিটি কর্পোরেশনকে এ অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর কার্যক্রমকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।’
×