ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসাই গরিবের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ১০ জুন ২০১৮

সরকারী হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসাই গরিবের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ সরকারী হাসপাতালে জটিল রোগসমূহের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সম্পন্ন করতে পারেন না অনেক রোগী। হয়রানির শিকার হওয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যের চিকিৎসায় নানাভাবে ফী দিতে হয় সরকারী হাসপাতালে। তাই তারা সহায়-সম্বল বিক্রি করেও বেসরকারী হাসপাতালের শরণাপন্ন হন। আর সরকারী হাসপাতালের সর্বোত্তম সেবা গ্রহণ করেন প্রভাবশালী লোকজন ও তাদের সুপারিশে পাঠানো রোগীরা, যা হতদরিদ্র লোকদের প্রাপ্ত। সরকারী হাসপাতালে জরুরী বিভাগ থেকে রোগীশয্যা পর্যন্ত পৌঁছার চিকিৎসা ব্যয় (ট্রলিম্যান ও শয্যা যোগানদাতা) লিখিত থাকে না। শয্যায় ওঠার পর চলে পরীক্ষা নিরীক্ষার খেলা। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কোন ফী নেই। ইউজার ফী আদায়ের নামে এখানে রোগীদেরকে ফী প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক পরীক্ষা বাইরে গিয়ে করাতে হয়। উচ্চ মূল্যের ওষুধ এবং চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে লেখা কোম্পানির ওষুধ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাওয়া না গেলেই রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। শুধু চিকিৎসককে এবং রোগীর খাবারের ক্ষেত্রে কোনো টাকা দিতে হয় না। তবে চুক্তিবদ্ধ বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য রোগী পাঠিয়ে সরকারী হাসপাতালে ফ্রী রোগী দেখার টাকা উঠিয়ে নেন অনেক চিকিৎসক। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে ট্রলিম্যানদের টাকা দিতে হয়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ফ্রী বেড বলে কিছু নেই। টাকা ও তদ্বির না হলে ফ্রী বেড পাওয়া যায় না। সার্জারি ও আইসিইউ রোগী হলে তো খরচের শেষ নেই। এভাবে পদে পদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ মেটাতে গিয়ে সরকারী ফ্রী চিকিৎসা যেন সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে! সরকারী স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় অংশই জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। আর দালালদের মাধ্যমে অর্থ লুট ও সীমাহীন হয়রানি সরকারী হাসপাতালের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে থাকে। সরকারী হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যের এবং ৩০ শতাংশ বেডের জন্য সামান্য ভাড়া নির্ধারিত আছে। এছাড়া রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীকে স্বল্প পরিমাণ ইউজার ফী বহন করতে হয়। ভাড়ায় বেডে থেকে এবং ইউজার ফী প্রদানের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিলেও কোন রোগীর মোট খরচের ১৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। সরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর আউটডোরে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা আর ভর্তি হতে ১৫ টাকা। ভর্তির পর থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সব ব্যয় সরকারই বহন করে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো বিভাগীয় পর্যায় থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। কেন্দ্র থেকে নাড়া দিলে স্বল্প সময়েই সারাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের চিত্র পাওয়া সম্ভব। ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩১ হাসপাতালে মোট ৪৯০ রোগী শয্যা রয়েছে। এ পর্যায়ে বিনা টাকায় নরমাল ডেলিভারি, মেডিসিন এবং সার্জারির সাধারণ সেবাসমূহ প্রদান করা হয়। উপজেলা পর্যায়ের ৪৬৫ হাসপাতালে মোট রোগী শয্যার সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার ৩০১। এ পর্যায়ে বিনা টাকায় মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও প্রসূতিসেবা এবং বেসিক অর্থোপেডিক, চোখ, নাক-কান-গলা ও হৃদরোগের সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ১৩২ উপজেলা হাসপাতালে ২৪/৭ সমন্বিত প্রসূতিসেবা এবং সকল হাসপাতালে নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। জেলা পর্যায়ের ৬৪ হাসপাতালে মোট রোগী শয্যার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ৩ শ’। এ পর্যায়ে বিনা টাকায় মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও প্রসূতিসেবা এবং অর্থোপেডিক, চোখ, নাক-কান-গলা, হৃদরোগসেবা প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশে ২০ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু রয়েছে। বাকিগুলি নির্মাণাধীন। পর্যায়ে মোট রোগী শয্যার সংখ্যা ১২ হাজার ৫৭৩। এখানে সকল বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, সিসিইউ ও আইসিইউ সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৫ বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীশয্যার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৮৮৪টি। এসব হাসপাতালে সকল বিশেষায়িত সেবা প্রদান করা হয়। যক্ষ্মা ও ফুসফুসের রোগের চিকিৎসা দিতে সারাদেশের ১৩ হাসপাতালে রয়েছে প্রায় ৮১৬ রোগীশয্যা এবং সংক্রামক ব্যাধি, কুষ্ঠ ও অন্যান্য রোগের জন্য ১৪ হাসপাতালে ৬১৫ রোগী শয্যা রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে সারাদেশে রয়েছে ১২ হাজার ৫৮৪ কমিউনিটি ক্লিনিক, ১ হাজার ২৭৫ ইউনিয়ন সাব সেন্টার এবং রয়েছে ৮৭ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সকল বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ৭টি জেলা হাসপাতালে মোট ২০৯ আইসিইউ বেড রয়েছে। সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহ এবং ১২ জেলা হাসপাতালে সিসিইউ চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। ক্যান্সার রোগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। জীবনরক্ষাকারী সব প্রকারের ওষুধ সরকারীভাবে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহের ওষুধের চাহিদা এবং সেই অনুযায়ী ওষুধের সরবরাহ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর বরাবর ওষুধের তালিকা ও বাজেট পেশ করেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহের কর্মকর্তরা। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ওষুধসমূহ ক্রয় করে থাকেন। জীবনরক্ষাকারী কোন ওষুধ যাতে বাদ না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়। কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কত প্রকারের ওষুধ লাগবে তা মূলত সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার পরিধির ওপর নির্ভর করে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের প্রয়োজন ও আবেদন অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহে কোন ঘাটতি নেই বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। নানা কৌশলে টাকা আদায় ॥ সরকারী হাসপাতালেও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগীরা। অথচ সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের। সরকারী হাসপাতালে কিছু ওষুধ, বেড ও অপারেশন বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও দামি ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবকিছুতেই অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগীদের। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছেন গরিব মানুষ। বিনা পয়সায় রোগ সারানোর আশায় সরকারী হাসপাতালে এসে তারা ভর্তি হওয়ার পর নিরুপায় হয়ে সহায় সম্বল পর্যন্ত বিক্রি করছেন। সরকারী হাসপাতালেও জটিল হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি, লিভারসহ অধিকাংশ রোগের চিকিৎসার পেছনেই বেশ অর্থ ব্যয় করতে হয়। পরীক্ষা ফী-ও বেশি। একটি সিটিস্ক্যান ও এমআরআই করাতে লাগে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। হতদরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে পরীক্ষাগুলোর সুযোগ থাকলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ইউজার ফী’র নামে টাকা আদায় ॥ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় এক দশক পর্যন্ত দেশে স্বাস্থ্যসেবা ছিল বিনামূল্যে। কিন্তু আশির দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক সরকারী হাসপাতালে ইউজার ফী নির্ধারণ করে। ফলে তখন থেকেই ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পেতে সাধারণ মানুষকে পকেট থেকে ব্যয় করতে হতো। দিন দিন বাড়তে থাকে ইউজার ফী বা আউট অব পকেট। এর আরেকটা কারণ দুর্নীতি। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সরকারী হাসপাতালে নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় দাবি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফী নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারী ফী বেসরকারী হাসপাতালের ফী’র তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। নিয়মের বাইরে গিয়ে অর্থ আদায় করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এভাবে ইউজার ফী-র নামে অর্থ আদায় অব্যাহত রয়েছে, যা আইনগত সিদ্ধ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্মকর্তারা। চিকিৎসা ব্যয় জরিপ ॥ আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর’বি, হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফাইন্যান্সিং রিসার্চ গ্রুপের সমন্বয়কারী ড. জাহাঙ্গীর এ এম খান জানান, সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ সরকার ও শ্রীলঙ্কার একটি সংস্থার সমন্বয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বিভিন্ন কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়া মানুষের প্রায় ২০ শতাংশ চিকিৎসা খরচ যোগান দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে সর্বশেষ এক গবেষণা অনুসারে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশের সীমিত আয়ের মানুষ। আয়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়। এই ব্যয়ের শতকরা ৬২ ভাগ নিজেদেরই বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের।
×