ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিস্তিন ॥ হতাশা থেকে জন্ম নেবে প্রতিহিংসা

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ৩০ মে ২০১৮

ফিলিস্তিন ॥ হতাশা থেকে জন্ম নেবে প্রতিহিংসা

সম্প্রতি এক নারকীয় পৈশাচিকতা ঘটে গেছে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ-ে। ১৪ মে জেরুজালেমে নতুন মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা যখন চলছিল সে সময় সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে ইসরাইল ও গাজার মধ্যকার বিভাজক কাঁটাতারের বেড়ার দিকে মিছিল করে আসা প্রায় আড়াই হাজার ফিলিস্তিনীর ওপর ঠা-া মাথায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ইসরাইলী সৈন্যরা ৬৪ জন হত্যা করে। ফিলিস্তিনীদের অপরাধ শুধু এটুকুই যে তারা তাদের শত শত বছরের পুরনো আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকীতে গাজা ভূখ-ের ফিলিস্তিনীরা কয়েক সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিনটি তারা ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয় হিসেবে পালন করে। কারণ ওই দিন জায়নবাদী মিলিশিয়ারা এক জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছিল। তখন থেকেই তারা নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত এক লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠী। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী যে ক্ষুদ্র ভূখ-টি মিসর ও ইসরাইলের গা ঘেঁষে বসেছে সেই গাজা আজ প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনীর আবাসভূমি। অথচ এদের সিংহভাগই এক সময় বাস করত সেই ভূখ-ে যা আজ ইসরাইল রাষ্ট্র নামে পরিচিত। এই জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়েছে এমন এক এলাকায় আয়তনে যা আমেরিকার ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার মাত্র দ্বিগুণ। তাদের নিজ ভূখ-ে ফিরে যাওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই, তেমনি সম্ভাবনা নেই তাদের জীবনযাত্রার উন্নতির। গত বছর গাজার এক একটি বাড়িতে দিনের ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুত ছিল। পানির সরবরাহ ছিল প্রতি চতুর্থ দিবসে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। সেখানে তরুণদের বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশ। গাজায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এক শিক্ষক আমল মুর্তজা কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরাইলী সীমান্তে হাজার হাজার মানুষের সমবেত হওয়ার কারণ জানিয়ে বলেন, পরিবারের ভরণপোষণ করার মতো কোন অর্থ এদের ছিল না। তাই তারা ভাবছিল ‘আমরা তো মরেই আছি। তাই বিক্ষোভ করেই মরি।’ মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের প্রতিবাদে এবং নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার জানাতে সুরক্ষিত ইসরাইলী সীমান্তে ফিলিস্তিনীদের সমবেত হওয়ার ধারণাটি প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে দেখা দেয়। তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-উপদল সেগুলোকে কাজে লাগায়। ইসরাইল এই বিক্ষোভ তার পরিণতিতে প্রাণহানির জন্য হামাসের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। ইসরাইলকে প্রশ্রয় দিয়ে মার্কিন প্রশাসন বলে যে ইসরাইলীদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। সুরক্ষিত সীমান্তের কাছে ফিলিস্তিনীদের বিক্ষোভের ফলে ইসরাইলের নিরাপত্তা কিভাবে বিপন্ন হয়েছিল তার কোন ব্যাখ্যা অবশ্য তারা দেয়নি। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনী প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র নগ্নভাবে একতরফা ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে ও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীন আবাসভূমির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে এসেছিল যে ফিলিস্তিনীদের সংগ্রাম হচ্ছে স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা লাভের জন্য এবং সেই রাষ্ট্রসত্তা অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র দূতিয়ালিও করে এসেছিল। কিন্তু এখন এই সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ার পথে। ফলে এক হতাশার সাগর গ্রাস করে নিয়েছে গাজাকে এবং সেই একই হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে পশ্চিম তীরও। গাজায় রয়েছে হামাসের শাসন আর পশ্চিম তীরে রয়েছে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের শাসন। মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ওই কর্তৃপক্ষকে অর্থায়ন করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। আমেরিকার চালে এই আব্বাস ইয়াসির আরাফাতের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিসের ভাষায় ‘শান্তির দূত’ আবাস স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র লাভের ব্যাপারে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন ফিলিস্তিনীদের। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরিক হওয়ার পর এখন সেই আব্বাস নিজেরই আশা হারিয়ে ফেলেছেন। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের কারণে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি জন্ম নিচ্ছে বেপরোয়া মনোভাব। ১৪ মে পশ্চিম তীরে এক ইসরাইলী চেকপয়েন্টের কাছে বিক্ষোভে অংশ নেয়া ৪১ বছর বয়স্ক গাসান ওয়াহদান বলেন, ‘সর্বত্র আমাদের তরুণদের দিকে তাকিয়ে দেখুনÑ তরা ইসরাইলী দখলদারদের বলছে আমরা মুক্তির জন্য জীবন দেব। আমরা সুন্দর জীবনযাপন করতে চাই, নয়ত কোন জীবনই চাই না।’ ফিলিস্তিনীরা এখন কিভাবে এগিয়ে যাবে সেটাই হবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অহিংস মোকাবেলার প্রবক্তা পশ্চিম তীরের কাদী কোরানের বক্তব্য হলো, ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলের হত্যাযজ্ঞ যে ভূমিকা পালন করেছিল ১৪ মে গাজার হত্যাযজ্ঞও সেই একই ভূমিকা পালন করবে। শার্পভিলে বর্ণবাদবিরোধী ৬৯ জন সংগ্রামীকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে সে দেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল। কোরান বলেন, এ বছরটি হতে যাচ্ছে সেই সময় যখন হয় অহিংস পন্থায় সংগ্রাম সফল হবে নয়ত বিশ্ব সমাজের ওপর আর নির্ভর করা যায় না এই উপলব্ধি থেকে ফিলিস্তিনীরা সংগ্রামের নতুন পথ বেছে নেবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনী সংঘাত হয়ত আর মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলন্ত প্রধান ইস্যু হয়ে থাকবে না। তবে সেটা যে ইন্ধনের অভাবের কারণে হবে তা নয়। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×