ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা

কলকাকলিতে মুখরিত মধুর পরিবেশ- ফিরে আসছে বহু পাখি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৬ মে ২০১৮

কলকাকলিতে মুখরিত মধুর পরিবেশ- ফিরে আসছে বহু পাখি

রফিকুল ইসলাম আধার ॥ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জনসচেতনতা বাড়ায় সবুজ শ্যামলীমায় সমৃদ্ধ শেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবারও ফিরছে হারিয়ে যাওয়া নানা প্রজাতির পাখি। ফলে জেলার খাল-বিল, নদী তীর আর বনবাদাড় এখন মুখর হয়ে উঠছে হারিয়ে যাওয়া ওইসব পাখির কলকাকলিতে। ঐতিহ্যের সেই পাখিগুলো আবারও দেখতে পেয়ে পাখি প্রেমিকসহ সকলেই যেমন মুগ্ধ হয়ে উঠছেন, ঠিক তেমনি সর্বত্র সৃষ্টি হয়েছে মিষ্টি-মধুর পরিবেশ। ‘ক্ষুদে জেলা শেরপুরের প্রাণ-পাহাড় নদী ধান’ হওয়ায় একসময় এ জেলার গাছ-গাছালির শ্যামলীমায় সমৃদ্ধ গ্রাম-গঞ্জ ও বন-জঙ্গলসহ খাল-বিল ও নদী তীরে দেখা যেত শত প্রজাতির পাখিদের সমারোহ। পাখি গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘরের কাছেই বা পাশের মাচায় যেমন হরহামেশাই দেখা যেত দোয়েল, শালিক, সারস, চড়ুই, বনবাদাড়ে ও গাছে ডাকত ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, বউ কথা কও, ঠিক তেমনি খাল-বিল, নদী তীরে বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেখা মিলত বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙাসহ অনেক পাখির। এটিই ছিল গ্রামীণ বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। যা চারপাশের পরিবেশকেও করে তুলত প্রাণবন্ত। কিন্তু এক শ্রেণীর লোভী মানুষের নির্বিচারে শিকারের কারণে এবং পাখির অভয়াশ্রমগুলো বিলুপ্ত হয়ে পড়ায় সেই পাখিগুলো এ অঞ্চল থেকে অনেকটাই হারিয়ে যায়। ফলে পাখিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের কোথাও যেন সেইসব হারিয়ে যাওয়া পাখির কিচির-মিচির শব্দ ও কলকাকলি শোনাই যাচ্ছিল না। হারিয়ে যাওয়া পাখিগুলো ফেরাতে শেরপুরে কাজ শুরু করে ‘পাখি পল্লব’, ‘শেরপুর বার্ড ক্লাব’, ‘এসএম ফাউন্ডেশন’, ‘শাইন’সহ বেশ কিছু স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন। ওইসব সংগঠন গত এক দশক ধরে পাখি ধরা, হত্যা বা বনের পাখি খাঁচায় বন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিকারিদের হাত থেকে উদ্ধার করা পাখি অবমুক্তকরণসহ শিকারিদের আইনের হাতে সোপর্দ করতেও পিছপা হয়নি তারা। সেইসঙ্গে তারা বিদেশী প্রজাতির গাছের বদলে দেশী প্রজাতির বৃক্ষ রোপণেও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের কর্মকা-ে উৎসাহ জোগায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ। ফলে হারিয়ে যাওয়া পাখিগুলো আবারও ফিরতে শুরু করে শেরপুর অঞ্চলে। জেলা সদরসহ ৫ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেই এখন দেখা মিলছে ওইসব পাখির। বিশেষ করে চেল্লাখালি, পাগলার মুখ, গজারমারী বিল, খলচন্দা, বাছুর আলগা, চন্দ্রকোনা, নারায়ণখোলা, তাওয়াকুচা, আয়নাপুর, গান্ধিগাঁও, বালিজুরি, বন্দভাটপাড়া, ভীমগঞ্জ, সাপমারী, গড়জরিপা, মালাকোচা, হাড়িয়াকোনা, বাবলাকোনা, গুরুচরণ-দুধনই, লছমণপুর, পাকুরিয়া, উরফা, গণপদ্দি এলাকার খালবিল ও ঝোপ-জঙ্গলেই ওইসব পাখিগুলো বেশি দেখা যাচ্ছে। পাখি পল্লবের সভাপতি শহীদুজ্জামান শহীদ (ফকির শহীদ) জানান, তাদের সংগঠনের মাধ্যমে ১৯৮৮ সন থেকে শেরপুর অঞ্চলে পাখি নিয়ে কাজ চলছে। এ জন্য তারা দেশী গাছ লাগানোসহ পাখি শিকার রোধ করতে জনসচেতনতা গড়ে তুলছেন। যে কারণে এখন জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তারা ১১০ প্রজাতির পাখির ছবি ধারণ করতে পেরেছেন এবং আরও বেশ কয়েক প্রজাতির পাখি দেখতে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে ৩ প্রজাতির কাঠবিড়ালী, বেশ কয়েক প্রজাতির গিরগিটি, ২ প্রজাতির বানরের সন্ধানও তারা পেয়েছেন। একই মত পোষণ করে বার্ড ক্লাব শেরপুর ইউনিটের সভাপতি সুজয় মালাকারের বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আওতায় একটি প্রকল্প চলমান থাকলেও তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তার মতে, সরকারী সহযোগিতা পেলে হারিয়ে যাওয়া পাখি ফেরাতে আরও যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে গ্রামীণ বাংলার হারিয়ে যাওয়া পাখি ফেরাতে জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নে ‘মুর্শিদপুর দরবার শরিফ’ এ গড়ে তোলা হয়েছে পাখির অভয়াশ্রম। আলহাজ খাজা মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা হায়দার ওরফে দোজা পিরের প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৪০ বিঘা জায়গাজুড়ে রয়েছে ৫০ প্রজাতির ৫ হাজার ফলদ ও বনজ গাছ-গাছালি এবং সেইসব গাছপালায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা অভয়াশ্রমে বাস করছে ময়না, টিয়া, শালিক, চড়ুই, বাবুই, কবুতর, ঘুঘু, বউ কথা কও, দোয়েল, বুলবুলি, শ্যামা, ফিঙ্গে, কাঠঠোকরাসহ নানা প্রজাতির নাম না জানা বিলুপ্ত প্রায় অসংখ্য পাখ-পাখালি। ওইসব পাখির আবাসস্থল নিরাপদ করতে এবং আরও নতুন নতুন পাখির আবাসস্থল গড়ে তোলার জন্য দরবার শরিফের পিরসাহেব নিজ উদ্যোগে প্রায় ৫ হাজার গাছে মাটির হাড়ি বা কলসি বেঁধে দিয়েছেন। ওইসব পাখির বাসা বা আবাসস্থল নিরাপদ করতে কলসির তলদেশ ছোট ছোট ছিদ্র করে দেয়া হয়েছে, যাতে বৃষ্টিতে পানি জমে পাখির বা বাসার কোন ক্ষতি না হয়। নিরাপদ আবাসের পাশাপাশি খাদ্যের ব্যবস্থাও থাকায় ওই অভয়াশ্রমে দিন দিন বাড়ছে পাখির সংখ্যা। এখন প্রতিনিয়ত হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে মুর্শিদপুর দরবার শরিফ ও তার আশপাশের পরিবেশ। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক পাখিপ্রেমী ভিড় করছেন ওই অভয়াশ্রমে। এ বিষয়ে দরবারের খাদেম আব্দুল জব্বার বলেন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আর ভক্তদের দীক্ষা প্রদানে প্রতিনিয়ত ব্যস্ততার পরও পিরসাহেবের পক্ষে ওই অভয়াশ্রম গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে কেবল পাখি বা জীবপ্রেমের কারণেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও ‘বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড’ এর রচয়িতা বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, দেশী পানকৌড়ি, ধলাচোখ তিসাবাজ, কমলাপেট ফুলঝুড়ি খুবই কম দেখা যায়। পাখি পল্লবের সদস্যরা শেরপুর অঞ্চলে অনেক প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া পাখি দেখতে পাওয়ার বিষয়টি একটি আনন্দের সংবাদই বলা যায়। পাখিদের বিচরণে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছু সংগঠন কাজ করায় জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে বলেই ওইসব পাখিদের দেখা মিলছে। পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার বিষয়টিকেও তিনি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
×