ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জেএসএস ও ইউপিডিএফ ত্যাগকারী বিভক্ত গ্রুপের নেতাকর্মীরা টার্গেট

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ মে ২০১৮

জেএসএস ও ইউপিডিএফ ত্যাগকারী বিভক্ত গ্রুপের নেতাকর্মীরা টার্গেট

মোয়াজ্জেমুল হক/ মোহাম্মদ আলী ॥ গত ৩ ও ৪ মে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে পৃথক দুটি কিলিং মিশন পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে পাহাড়ের স্বঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠন জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) ও ইউপিডিএফ মূল অংশের গোপন পরিকল্পনা। এই দুই সংগঠন থেকে বেরিয়ে যারা উপগ্রুপ সৃষ্টি করে নেতৃত্বে আসছেন তাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ বিভক্ত হয়ে চারগ্রুপ পাহাড়ী জনগণের দাবি দাওয়া আদায়ের কথা বলে নেতৃত্ব দিতে ব্যাপক তৎপর। আর এ তৎপরতার পথে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সশস্ত্র সহিংসতার। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির পর জেএসএসের আর্মড শাখা শান্তি বাহিনী (বর্তমানে লুপ্ত) খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সন্তু লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র আত্মসমর্পণ করার পর সংগঠন থেকে বেরিয়ে যায় প্রসীত খিসা ও সঞ্চয়ের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের সদস্যরা। পরে তারা জন্ম দেয় ইউপিডিএফ নামের সংগঠনটি। জেএসএস ও ইউপিডিএফের অন্তর্কোন্দল, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের অপতৎপরতা দিনে দিনে কেবলই ব্যাপৃত হয়েছে। এরপর জেএসএস থেকে একগ্রুপ বেরিয়ে গঠন করে জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপ। আরও পরে ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে আলাদা হয়ে যায় আরেক গ্রুপ। যারা নিজেদেরকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। এ দুই সংগঠনের চারগ্রুপের হানাহানি ও সঙ্ঘাতে প্রাণহানির অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। গুম করা হয়েছে অনেককে। সর্বশেষ গত ৩ মে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ সভাপতি শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের যোগদানের পথে বেতছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমাসহ ৬ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ইউপিডিএফ সংস্কারপন্থীদের তিন শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছাড়া হয়েছে। পুরো এলাকায় এখনও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পৃথক পৃথক দুটি হত্যাকা-ের ঘটনা নিয়ে স্বজনদের কেউ একটি জিডি বা মামলা করার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের তপন জ্যোতি চাকমাকে হত্যার পর সংগঠন পরিচালনায় ১১ সদস্যের যে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে প্রসীত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের পক্ষে তাদেরকে নব্য মুখোশ বাহিনী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, জেএসএস (সন্তু) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের শীর্ষস্থানীয়রা পাহাড়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েমের হীন স্বার্থে উভয় সংগঠনের সংস্কারপন্থীদের খুন, গুম ও অপহরণ করার মিশনে নেমেছে। জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মতে, পাহাড়ী শান্তিচুক্তি হয়েছে শান্তি ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রম স্থিতিশীল রাখার জন্য। এছাড়া কথিত মানুষের তার পছন্দনীয় দল করার অধিকারও রয়েছে। সে অধিকারকে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে আধিপত্যবাদী মনোভাবারা। এরা একগ্রুপ আরেক গ্রুপকে দায়ী করছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস দায়ী করে আসছে ইউপিডিএফকে। আর উভয় সংগঠনের বিভক্ত গ্রুপগুলোও একে অপরকে বিভিন্ন ঘটনার জন্য দায়ী করে আসছে। গত ৩ ও ৪ মের ঘটনার পর ইউপিডিএফের পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠিত হওয়ায় নানিয়ারচরে সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি আরও বেড়েছে। দুদিনের ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। শুধু বাঙালী নয়, পাহাড়ীরাও তেমন প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে না। যাচ্ছে না হাটবাজারেও। নানিয়ারচর সড়ক মূলত বন্ধই রয়েছে। এ ভীতিময় পরিস্থিতি কেবলই বিস্তৃতি লাভ করছে। কখন কোথায় কাকে হত্যা করা হয় এ নিয়ে সন্ত্রস্ত অনেকেই। উল্লেখ করা যেতে পারে, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের তপন জ্যোতি চাকমার বাড়ি নানিয়ারচরে। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৬ দিনের মাথায় প্রসীত খিসা ও সঞ্চয়ের নেতৃত্বে ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশ করে। এ দলের সামরিক শাখার প্রধান নিযুক্ত হন তপন জ্যোতি চাকমা। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ক্যাডার। শান্তি চুক্তির পর জেএসএস নেতা সন্তু লারমা খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আঞ্চলিক পরিষদে যোগ দিতে আসার পথে নানিয়ারচর সীমান্তে তার গাড়িবহরে প্রথম আক্রমণের শিকার হয় তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বাধীন ক্যাডার বাহিনী। এরপর তপন জ্যোতির গ্রুপ খাগড়াছড়ি ৪টি ও রাঙ্গামাটি ৩ উপজেলায় তাদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। ২০১৫ সালে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে সুফলও এসেছিল। গত ১৫ নবেম্বর ইউপিডিএফ থেকে তপন জ্যোতির নেতৃত্বাধীন গ্রুপ বেরিয়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকে বেশকিছু হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ তপন জ্যোতি চাকমা নিজেই হত্যার শিকার হলেন। পাহাড়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ এবং তাদের বিভক্ত গ্রুপগুলো হানাহানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনায় পাহাড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় যে ভীতিকর পরিস্থিতির সঞ্চার হয়েছে তা আগামীতে কোথায় দাঁড়াবে তা কেবল ভবিষ্যতেই বলে দেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর অভিমত।
×