ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেয়ার অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করতে আইন সংশোধন

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

শেয়ার অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করতে আইন সংশোধন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ তালিকাভুক্ত কোম্পানির ন্যূনতম ১০ শতাংশ বা এর বেশি সংখ্যক শেয়ার অধিগ্রহণ অর্থাৎ কেনার প্রক্রিয়া সহজ করতে সংশ্নিষ্ট আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে সহজ করতে গিয়ে এ আইনের নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তদন্ত ও শাস্তির বিধান সম্পর্কিত বিদ্যমান আট ধারার পুরো অধ্যায়টি বাদ দেয়া হয়েছে চূড়ান্ত খসড়ায়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানির ১০ শতাংশ বা এর বেশি শেয়ার কিনতে হলে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংঘবদ্ধ গ্রুপকে আগাম ঘোষণা দিতে হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, এ ঘোষণা স্টক এক্সচেঞ্জকে জানাতে হয় এবং অন্তত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে দিতে হয়। আইনের এ বিধান অহরহ লঙ্ঘন হচ্ছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বিষয়ে নিশ্চুপ। যদিও এ আইনের বিধান ভঙ্গের দায়ে সংশ্নিষ্টদের শেয়ার ব্যবসা না করার নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা আছে বিএসইসির। এ ছাড়া কমিশন চাইলে সংশ্নিষ্টকে ক্রয় করা শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা বা অবিলম্বে বিক্রির নির্দেশও দিতে পারে। এর বাইরে অন্য শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা আছে সংস্থার, যা আইনটিতে উল্লেখ আছে। এ ছাড়া শেয়ার ক্রয়ে জড়িত ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুযোগ আছে। গত বৃহস্পতিবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার অর্জন, অধিগ্রহণ ও কর্তৃত্ব গ্রহণ শীর্ষক ২০০২ সালের বিধিমালাটি ব্যাপক সংশোধন করতে খসড়া চূড়ান্ত করেছে কমিশন। এরই মধ্যে জনমত যাচাইয়ের জন্য তা সংস্থার ওয়েবসাইট ও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে শুধু স্টক এক্সচেঞ্জকে জানালেই হবে এবং স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশের আগে ওই শেয়ার কেনা যাবে না। তবে দুর্বল মৌল ভিত্তির কোম্পানিকে পুনরুজ্জীবিত করতে শেয়ার কিনতে চাইলে উদ্দেশ্য ও শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণবিষয়ক বিস্তারিত জানিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ ও দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। এখানে দুর্বল কোম্পানি বলতে পুঞ্জীভূত লোকসানি কোম্পানি বা সর্বশেষ তিন বছর অভিহিত মূল্যের নিচে বাজারে শেয়ারটি কেনাবেচা হচ্ছে বা সর্বশেষ পাঁচ বছর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় না-এমন কোম্পানিকে বোঝানো হয়েছে। তবে সংশোধিত আইনের খসড়ায় এ বিধান অমান্য করলে কী হবে, তা বলা হয়নি। বরং বিদ্যমান আইনের সব ধারা সংবলিত পুরো পঞ্চম অধ্যায়টি বাদ দেয়া হয়েছে। আইনজ্ঞরা জানান, আইনের গঠনে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সেসব বিধান উল্লেখ থাকতে হয়। সংশ্নিষ্ট আইনের ধারা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করে তদন্ত সংক্রান্ত ও শাস্তির বিধান থাকা আবশ্যক। এ তথ্য জানা নাগরিক অধিকার। এগুলো না থাকার অর্থ আইনটি অসম্পূর্ণ। অন্য কথায় বলা যায়, আইন লঙ্ঘনের শাস্তি অনির্দিষ্ট বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ইচ্ছাধীন বিষয়। এক্ষেত্রে একই বিধান লঙ্ঘনের দায়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভেদে শাস্তিও ভিন্ন হওয়ার সুযোগ থেকে যায় বলে তারা মন্তব্য করেন। জানতে চাইলে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আইন লঙ্ঘনের শাস্তি কী, তা না থাকলে আইনটি পূর্ণাঙ্গ হয় না। একই সঙ্গে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে তদন্তের পদ্ধতি ও কর্মকর্তা নিয়োগে সুস্পষ্ট বিধান রাখাও আবশ্যক। এমন বিধান না রেখে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কমিশনের এমন আইনের সমালোচনা করেছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অনেকে। তবে কেউ সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। শীর্ষস্থানীয় এক মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রস্তাবিত খসড়া এতটাই সহজ করা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট বিধান লঙ্ঘনে কোনো শাস্তি হবে না। কিছু পদক্ষেপে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো, অথচ তার কারণে শাস্তি কী হবে, সেটি বলা হলো না। এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, উল্লেখযোগ্য শেয়ার বলতে কমিশন কোন কোম্পানির মোট শেয়ারের ১০ শতাংশকে বুঝিয়েছে। তবে এটা আরও সংশোধন করে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। এর কারণ ব্যাখ্যায় ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০০২ সালে যখন আইনটি করা হয়েছিল, তখন দেশের শেয়ারবাজারের আকার, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা এবং একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্ষমতা কম ছিল। ওই সময় দিনে দুই থেকে তিন কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হতো। এখন কম হলেও একদিনে ২০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। কখনও কখনও তা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অর্থাৎ ১৬ বছর আগের তুলনায় বর্তমান বাজারের আকার অনেক বড় হয়েছে। অনেকের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ক্ষমতা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে শেয়ারবাজারে এই যে পরিবর্তন হয়েছে, আইনের প্রস্তাবিত সংশোধন দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ফলে এখানে উল্লেখযোগ্য শেয়ার বলতে ১০ শতাংশ শেয়ার না বুঝিয়ে তা কমিয়ে ৫ শতাংশ করা উচিত। অনেক দেশে এ হারকেই স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনা করা হয়। এমনকি বর্তমান কমিশনের অন্য এক আদেশে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির জন্য ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণকারীর তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক। অথচ এই আইন সংশোধনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গঠিত কমিটি উল্লেখযোগ্য শেয়ারের সংজ্ঞা ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার সুপারিশ করেছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। তবে কমিটির ওই সুপারিশ কমিশন সভায় গ্রহণ করা হয়নি। জানতে চাইলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদ বিভাগের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ মূসা বলেন, কমিশনের কর্মকর্তারা এই সময়ে এসে কেন উল্লেখযোগ্য শেয়ার বলতে ২০ শতাংশকে বুঝিয়েছিলেন, তা কোনোভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। তাদের ওই প্রস্তাব শেয়ারবাজারে কারসাজিকে উৎসাহিত করবে। আইন সহজ করার অর্থ এই নয় যে, এমন ব্যবস্থা করা যাতে, আইনের উদ্দেশ্য লঙ্ঘন করেও পার পাওয়া যায়। এর আগে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির পরিচালকদের জন্য ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করে জারি করা নির্দেশনা গত ছয় বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি মন্তব্য করে অধ্যাপক মূসা বলেন, দেশের শেয়ারবাজারে ৫০ লাখ টাকা থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার মূলধনী কোম্পানি আছে। ফলে সব কোম্পানির উল্লেখযোগ্য শেয়ার এক হওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ করার পরামর্শ দেন তিনি।
×