ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

আড়াই শ’ বছরের পুরনো ছাতিয়ানির চড়ক মেলায়

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২০ এপ্রিল ২০১৮

আড়াই শ’ বছরের পুরনো ছাতিয়ানির চড়ক মেলায়

সূর্যদেব তখনও আঁখি মেলেন নাই মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। এর মাঝে টিক টিক করে বেজে উঠল ঘড়ি। এদিকে আমি নিদ্রা দেবীর আবেশে আবিষ্ট। এ্যালার্ম বেজেই চলছে তার আপন মনে আর আমি ঘুমাচ্ছি মাথার ওপর বালিশ দিয়ে যেন ঘড়ির শব্দ কানে না পৌঁছে। কিছু সময় পর আবার বেজে উঠল এ্যালার্ম এবার অনেক বিরক্তি নিয়ে এ্যালার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এদিকে সুজন মামার ফোন, ঘুম থেকে উঠেছিস নাকি। তোরা দ্রুত তৈরি হয়েনে তা না হলে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে। শেষ পর্যন্ত ঘুম থেকে উঠতেই হলো আমার। এদিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ছাড়া বাকি সবাই মোটামুটি প্রস্তুত। আমার সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্ত আমার অবস্থা দেখে অবজ্ঞার সুরে বলে উঠলেন এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলে তোমার সূর্য মামা তো এখনও ঘুমে। আমি দ্রুত প্রস্তুতি হয়ে নিলাম সুজন মামা ও এসে উপস্থিত বাসায়। কিন্তু আমাদের পাইলট মহোদয়ের দেখা নেই। ফোন দেয়ার পর ওপরপ্রান্ত থেকে বলল দাদা আমি রাস্তায় আসছি কিন্তু তার ভাবগতিতে বুজতে পেলাম ড্রাইভার মহোদয় ফোন পাবার পর ঘুম থেকে উঠেছেন। প্রায় আধা ঘণ্টার পর আমাদের মহামান্য ড্রাইভার সাহেব এসে উপস্থিত হলে আমাদের নতুন গন্তব্যে নিয়ে যাবেন বলে। গেল পহেলা বৈশাখের কথা আমরা যাচ্ছি ঢাকার অদূরে অবস্থিত কালীগঞ্জের জাঙ্গালীয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানি গ্রামের আড়াই শ’ বছরের পুরনো ছাতিয়ানি চড়ক মেলায়। ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল আঁটটা বাজি বাজি মতিঝিল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এক নতুন স্নিগ্ধ সকালে আমরা এগিয়ে চলছি। সবার পরনে নতুন জামা কাপড় সবাই চলছে বৈশাখী আয়োজনে অংশ নিতে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাহারি রঙ্গের জামা কাপড় পরে বেড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের দিকে যাবে। সবাই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য। দেখে খুব ভালই লাগল। সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর পেরিয়ে এগিয়ে চললাম ছাতিয়ানির দিকে। মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি কিছু সময় পরপর যান্ত্রিক জ্যামের মধ্যে পড়তে হচ্ছে আমাদের। সবাই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ সফল ও হচ্ছেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চলল মহাসড়কে আছি কারও পেটে দানাপানি পড়েনি। সবাই বলি বলি করে বলে উঠতে পারছিল না এখন বিরতিতে যাওয়ার প্রয়োজন। পেটে কিছু দিতে হবে। কেউ কিছু বলছে না দেখে আমি নিরুপায় হয়ে বললাম অনেক সময় তো হলো এবার পেটে তো কিছু দিতে হয়। সবাই দেখি আমার কথায় সহ মত প্রকাশ করলেন। যেই বলা সেই কাজ পাইলট সাহেবকে গাড়ি থামাতে বলা হলো। নরসিংদীর বিখ্যাত মাতৃ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গিয়ে আমরা উপস্থিত। আমাদের ভোজনরসিক পৃথু বলে উঠল মামা গরম গরম যা আছে তা তাড়াতাড়ি দেন পেটে অনেক খিদে লেগেছে। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে লুচি আর পরোটা হাজির। গরম গরম লুচি আর পরোটার স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। এদিকে চিন্টু বলে উঠল দাদা মিষ্টি খাব আমি বললাম ঠিক আছে। সবার জন্য মিষ্টি নেয়া হলো মাত্র ডেগ থেকে তুলে আনা হয়েছে। গরম মিষ্টি খেতে বেশ স্বাদ, প্রত্যেকেই একাধিক মিষ্টি চেখে দেখল। এদিকে সুজন মামা বলে উঠল আর দেরি করা যাবে না ওই দিকে তো চড়ক পূজা শুরু হয়ে যাবে। দেরি করে পৌঁছলে তো কিছুই দেখতে পাবে না। পেট পূজা শেষ করে আমরা চললাম গন্তব্য পানে। ঘোড়াশালে এসে সেই কোন সময় থেকে বসে আছি যানবাহন সামনের দিকে এগুতেই চাইছে না। কে কার আগে যেতে পারবে এ নিয়ে চলছে এক অসম প্রতিযোগিতা। তবে আমাদের পাইলট সাহেব তার নিজের গতিতেই চলছেন। গাড়িতে বসতে বসতে সবাই খুব ক্লান্ত। কাপাসিয়া মোড়ে আসতেই মামা ঘোষণা দিলেন আমরা প্রায় চলে এসেছি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। পথিমধ্যে দেখা পেলাম আমাদের মতো অনেকেই যাচ্ছেন চড়কমেলা দেখতে। মূল গন্তব্য স্থলের বেশ আগেই আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। হাজার হাজার মানুষের পদভারে মুখর পুরো এলাকা। এখনও আমরা পিচঢালা রাস্তায় আছি দূর থেকে সোদা মাটির ঘ্রাণ আসছে। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চললাম অসাধারণ পরিবেশ। রাস্তার দুই ধারে বসেছে বৈশাখী মেলা। মেলার প্রতিটি দোকানে ভিড় করে আছে ছোট থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণীর মানুষ। মাটির খেলনা, লেইস ফিতা, আসবাবপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, কাঠের সামগ্রী, হস্তশিল্প, কার পণ্য, তামা, কাঁসা, লোহা কি নেই মেলায়। আরও কিছুদূর যেতেই দেখা পেলাম একটি পুকুর ঘিরে আছে কয়েক হাজার মানুষ আমরা ও সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুরের মাটি দিয়ে বাঁধানো পাড়। পুকুরপাড়ের বটগাছ দেখে এর প্রাচীনতা বোঝা যায়। চারপাশে ধূপ কাঠির গন্ধে মোহিত হচ্ছে, বেজে চলছে ঢাক এ এক অন্যরকম অনুভূতি। সবাই দেখলাম পুকুরপাড়ে রাখা চড়ক গাছে পূজা দিচ্ছেন। আমি ছবি তোলার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু ভিরের জন্য কোন ছবিই তুলতে পারলাম না। সুজন মামা বলছিলেন এখানে চড়ক পূজা স্থানীয়দের কাছে চড়কদেশের পুকুরের পূজা নামেই পরিচিত। আমি মনে মনে ভাবছিলাম এ কেমন কথা মামা তখন আমাকে বুঝিয়ে বলল প্রতি চৈত্রসংক্রান্তির পূজার পর পুকুরে চড়কগাছ ভিজিয়ে রাখা হয় বলে এই নাম। পুকুরে ভিজিয়ে রাখা এই চড়কগাছ প্রায় আড়াই শ’ বছর ধরে পূজা করে আসছে স্থানীয় লোকজন। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন কি বিদেশ থেকে ও লোক আসেন পূজা দেখতে। আমরা কিছু দূর এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম বর্তমানে চড়ক পূজা ও চড়কমেলাটি যারা পরিচালনা করেন তাদেরই একজন কমল কুমার গুপ্তের সঙ্গে তিনি বললেন এই চড়ক পূজা ও মেলার প্রচলন হয় তৎকালীন স্থানীয় ধনাঢ্য হিন্দুপরিবার। যাদের বেশির ভাগ পরিবার ’৪৭-এর দেশ ভাগ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। এই মেলাটি পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির দিন। কমল কুমার গুপ্ত আরও বলেনÑ আমাদের এই ছাতিয়ানি গ্রামের চড়ক মেলাটি প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে থেকে হয়ে আসছে। চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে সন্ন্যাসীরা উপবাস থেকে সারাদিন গ্রাম থেকে চাল সংগ্রহ করেন। রাতে শিবপূজা শেষ করে উপবাস ভাঙেন। তাদের এই চাল সংগ্রহ করাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ডেউল উঠানো। সাত দিন উপবাস থেকে গ্রাম থেকে চাল সংগ্রহ করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন হয় হরগৌরি (স্থানীয়দের ভাষায় আজরা) পূজা। তাদের বিশ্বাস এই পূজা করার পর সন্ন্যাসীদের উপর ভূত ভর করে। তখন ভূতেরা গ্রামের ও ভক্তদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের বিষয়ে ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে থাকেন। আজ চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকালে ঢাক কাস বাজাতে বাজাতে পূজারিরা চড়কদেশের পুকুর (যে পুকুরের পানিতে চড়কগাছ ভিজিয়ে রাখা হয়) পাড় দিয়ে আড়াইটি পাক দিয়ে চড়ক গাছ পুকুর থেকে তুলে পুকুরপাড়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রথমে সন্ন্যাসীরা পূজা করেন তার পর অন্যরা পূজা দিয়ে থাকেন। আমরা দেখতে পেলাম অনেকেই পুকুরপাড়ের বটতলায় বাচ্চাদের মাথা চুল কেটে দিচ্ছে। দেখে আমি একটু অবাকই হলাম, জানতে চাইলাম কেন এমনটি করা হচ্ছে উত্তরে কমল কুমার গুপ্ত বললেন এখানকার স্থানীয় লোকজন তাদের বাচ্চাদের মঙ্গল কামনায় মানত করে আর সেই মানত অনুযায়ী বাচ্চাদের চুল পুকুরপাড়ের বটতলায় উৎসর্গ করেন আবার কেউ কেউ পুকুরের জলে বিভিন্ন ফল ভাসান। সেই ফল যে কোন মানত করে খেলে মনুষের মনোবাসনা পূর্ণ হয় তারা বিশ্বাস করেন। আমি ও এগিয়ে গেলাম পুণ্য লাভের আশায়। মানুষের ভিড় ঠেলে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখা পেলাম গুপ্ত পরিবারের আরেক সদস্য নির্মল গুপ্তের সঙ্গে। আমাদের কে দেখে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন হাসি মুখে বরণ করে নিয়ে গেলেন শিব মন্দিরে। তিনি বললেন চড়কপূজা শেষ করে সন্ন্যাসীরা চলে আসেন শিব মন্দিরে পূজা করতে। এই মন্দিরটির সামনে রয়েছে আরেকটি বটগাছ। এই বটগাছের নিচে নিজেদের মনের কাম ক্রোধ পশুত্ব বিসর্জনের জন্য পশু উৎসর্গ করা হয়। আমরা মন্দিরে পাশে বসলাম এদিকে আমার পেটে খুব লেগেছে সেই কখন খেয়েছি। আমার মতো সবারই একি অবস্থা। আমাদের অবস্থা অনুমান করতে পেরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের আহারের জন্য নানা ধরনের ফল পরিবেশন করা হলো। আমি কারোর জন্য অপেক্ষা না করেই খাওয়া শুরু করলাম। আগে পেট পূজা করি পরেরটা পরে বোঝা যাবে। এক নিঃশ্বাসে পেট পূজা শেষ করে অন্যদের দিকে খেয়াল করলাম। সবারই একি দশা চুপচাপ কোন কথা না বলে খেয়েই যাচ্ছে সবাই। যাই হোক পেট পূজা শেষ করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম মেলা দেখতে। কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেলাম পশু উৎসর্গের পাশাপাশি চলছে শিবপূজা, বাতাসা উৎসর্গ, কবুতর উৎসর্গ। তবে এখানে বাতাসা উৎসর্গ করা হয় অভিনব পন্থায়। ব্যাগ ভর্তি বাতাসা হাতে করে ছিটিয়ে দেয়া হয় মন্দিরের চালে। চাল থেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই বাতাসা পড়তেই প্রসাদের মতো সম্মান করে ভক্তরা তুলে নেয়। দেখে বেশ মজাই পেলাম আমরা। বেশিরভাগ বাচ্চারাই উৎসাহ ভরে বাতাসা সংগ্রহ করে খাচ্ছে। সামনে এগিয়ে যেতে দেখা পেলাম খাবার সামগ্রী নিয়ে বসেছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মিষ্টির দোকানিরা। নিমকি, মুরালি, মোয়া, তিলা, খাজা, কদমা, খাস্তা, পিয়াজু, শখের মিঠাই, মোয়া, বাতাসা আরও কত কি। সুজন মামা বলল এখানে মিষ্টিগুলোর মধ্যে উত্তম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাঁচা গোল্লা মিষ্টি, ক্ষীরসাই বেশ প্রসিদ্ধ। আমরা এগিয়ে গেলাম হরেক রকমের মিষ্টির স্বাদ নিতে। দেখা পেলাম গুপ্ত পরিবারের নির্মল গুপ্তের সঙ্গে উনি আমাদের নিয়ে গেলেন লোকনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোকানে সেখানে গুড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে গরম গরম জিলাপি। নগরে গুড়ের জিলাপির দেখা পাওয়া দুষ্কর। আমরা দেখে তো জিভে জ্বল আসার জোগাড়। আমাদের সামনে গরম গরম জিলাপি পরিবেশন করা হলো অসাধারণ স্বাদ। প্রথমবারের মতো গুড়ের জিলাপি খেলাম এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এতসব খাবার পরে আয়োজক পরিবারের পক্ষ থেকে গরম গরম ভুনা খিচুড়ি খাবার অনুরোধ করা হলো সুজন মামা এক কথায় না বলে দিলেন এত কিছু খাবার পর আর কিছু খাওয়া ওনার পক্ষে সম্ভব না। বিপরীত দিকে আমার আবার ভুনা খিচুড়ি প্রিয় খাবার তাও প্রসাদ বলে কথা তাই আমি এই আমন্ত্রণ মিস করতে চাইলাম না। দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে সূর্য দেবের বিদায় নেয়ার পালা সুজন মামা ঘোষণা দিলেন আমাদের ও ফিরে যেতে হবে শহর পানে আর দেরি করা চলবে না তাই আমরা ছুটে চললাম যান্ত্রিক নগরীর দিকে। যাবেন কীভাবে- ঢাকা থেকে বিভিন্নভাবে যেতে পারবেন ছাতিয়ানির চড়ক পূজায় যাবার প্রথম পথ হলো গুলিস্তান থেকে নরসিংদীগামী বাসে উঠে নামতে হবে নরসিংদীর পাঁচদোনায় সেখান থেকে কালীগঞ্জগামী বাসে উঠতে হবে নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে সেখান থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানি। মহাখালী থেকে যেতে চাইলে আপনাকে উঠতে হবে চলনবিল/বাদশা বাসে আপনাকে নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে। কাপাসিয়া মোড় থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানির চড়ক পূজায়। অথবা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে।
×