ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজিজের স্বপ্ন জাতীয় পর্যায়ে প্রদর্শনী আয়োজন

ফুচকা বিক্রেতার হাতে শিল্পের ছোঁয়া, ছবি দেখে মুগ্ধ দর্শক

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

ফুচকা বিক্রেতার হাতে শিল্পের ছোঁয়া, ছবি দেখে মুগ্ধ দর্শক

এস এম জসিম উদ্দিন ॥ পেশায় তিনি ফুচকা বিক্রেতা। সারাদিন ফুচকা-চটপটি বিক্রি করলেও রাত জেগে সাদা কাগজে পেন্সিলে ছবি আঁকা তার দীর্ঘদিনের নেশা। ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের কোণায় ছোট একটি দোকানে ফুচকা বিক্রি করেই সংসার চালান তিনি। তার আঁকা ছবি ইতোমধ্যে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। জেলা প্রশাসন চলতি বছর স্থানীয়ভাবে অনুষ্ঠিত একুশের বইমেলা চত্বরে তার ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না পেয়েও একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রতিভা দেখে মেলায় আসা অনেকেই অবাক হন! ফুচকা বিক্রেতার হাতে শিল্পের ছোঁয়া; এমন প্রতিভা দেখে যুগপৎ অবাক ও মুগ্ধ হন দর্শক। এই অবস্থায় শিল্পী আজিজ স্বপ্ন দেখেন তার আঁকা ছবি নিয়ে জাতীয়ভাবে প্রদর্শনী করার। দীর্ঘদিন থেকে ‘ফুচকা বিক্রেতা আজিজ ভাই’ বলে পরিচিতির পাশাপাশি চিত্রশিল্পী হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। তিনি দিনের আলোতে যেমনি নিপুণ হাতে সুস্বাদু ফুচকা-চটপটি বানিয়ে বিক্রি করেন তেমনি নিঝুম রাতে বসে কাঠ পেন্সিলের মাধ্যমে নীরবে-নিভৃতে বসে ছবি আঁকেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। আজিজ ছবি এঁকে জমিয়ে রাখছিলেন। শত ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অভাবে ছবির প্রদর্শনী করতে পারছিলেন না। এক সময় এগিয়ে এলেন সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল। তিনি এই দরিদ্র চিত্রশিল্পী আজিজের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে তখন অনুষ্ঠিত হয় ৯ দিনব্যাপী একুশের বইমেলা। সেই মেলাচত্বরে আজিজের আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হলে তার প্রথম ধাপের স্বপ্ন পূরণ হয়। বইমেলায় প্রতিদিন আগত সকল বয়সের মানুষজন ফুচকা বিক্রেতা আজিজের আঁকা অসাধারণ ছবি-প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। কাজের অবসরে মানবিক মূল্যবোধসহ বিভিন্ন ছবি আঁকার চেষ্টা করেন আজিজ । তিনি এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ছবি এঁকেছেন শুধু পেন্সিলের মাধ্যমে। তিনি ভবিষ্যতে তার আঁকা ছবি নিয়ে ঢাকায় জাতীয়ভাবে একটি প্রদর্শনী করার স্বপ্ন দেখেন বলে জানান। এ ব্যাপারে সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল জানান, সমাজে অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন, সুযোগের অভাবে তারা তাদের প্রতিভার প্রকাশ করতে পারেন না। এই অসহায়দের মতো ফুচকা বিক্রেতা আজিজ একজন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আরও এমন প্রতিভাবানকে খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে। চিত্রশিল্পী আজিজের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, আমি রাত্রীকালীন স্কুলে পড়ালেখা করেছি। দিনেরবেলা হোটেলে কাজ করে রাতে পড়তে যেতাম। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। সংসার মূলত বড় ভাই চালাত। পরবর্তীতে ভর্তি হন ঠাকুরগাঁও রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে যেখানে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় গিয়ে তিনি একটি ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করতেন দিনে, রাতে পেন্সিল আর কাগজ হাতে নিয়ে ছবি আঁকতেন। ফুচকা বিক্রিকে পেশা আর ছবি আঁকাকে নেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল, এর মাঝে নানা প্রতিকূলতা তাকে দমাতে পারেনি। দীর্ঘ ১৫ বছর ঢাকায় থাকার পর তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে ফুচকা-চটপটির দোকান দেন এবং ক্ষণিক অবসরে ছবি আঁকতেন দোকানে বসেই। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি আঁকার আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই। আমার বন্ধুদের ছবি আঁকা শেখাতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু ওরা অনেকেই আমাকে বলেছিল তুই তো পড়ালেখা জানিস না তুই আর কী আঁকবি। এই কথা আমার মধ্যে জেদ সৃষ্টি করেছিল এবং সেই জেদ থেকেই আমি ছবি আঁকা শুরু করি। আজিজ তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, শিল্পকর্ম বিষয়টা তার খুব ভাল লাগে। কে দেখল, কে দেখল না, কি হলো না- তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। তার স্বপ্ন একটাই- ঢাকায় একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারলেই তার সব ইচ্ছে ও স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তুু সংসার বা পরিবারের কারণে অথবা যোগাযোগের অভাবে তার স্বপ্ন বাস্তব হচ্ছে না।
×