ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী আয়োজনে রসগোল্লা

বাঙালীর মিষ্টি-প্রেম, এমন ঐতিহ্য আর কোথাও নেই...

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১১ এপ্রিল ২০১৮

বাঙালীর মিষ্টি-প্রেম, এমন ঐতিহ্য আর কোথাও নেই...

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর সৃষ্টি রসগোল্লা। বাঙালীর বর্ষবরণ হবে তাতে রসগোল্লা থাকবে না তা কি হয়! রসের সাগরে ডুবে থাকা সাদা এক গোল মিষ্টি। বৈশাখকে সামনে রেখে ময়রারা (রসগোল্লা তৈরির কারিগর) এখন মহাব্যস্ত। বাঙালীর জীবনের সব আনন্দের সঙ্গী মিষ্টি। ঐতিহ্যের এমন মিষ্টি সংস্কৃতি আর কোথাও নেই। রসগোল্লা মিষ্টি সমাজের হিমালয়চূড়া। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে চমচম, সন্দেশসহ কত কী। অষ্টাদশ শতকে চিনির সিরায় ছানা গোল করে চুবিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা। রসে টাইটুম্বুর বাঙালীর রসগোল্লার বৈচিত্র্য কম নয়। রসগোল্লার পুরনো নাম গোপাল গোল্লা। গোপালকে সিরায় ডুবিয়ে হয়েছে রসগোল্লা। এর চারধারে ভিড় করে থাকে পানতোয়া, চমচম, কালোজাম, রসমালাই, রসমঞ্জুরি, রসকদম, মন্ডা ইত্যাদি। ভারতবর্ষের প্রথম দিকের গবর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর নামেও ময়রা একটি বিশেষ রসগোল্লা বানিয়েছিল। নাম দেয়া হয় লেডিকেনি। এই রসগোল্লা মিষ্টির বাজারে রাজার সিংহাসনে বসে। বাকিগুলো মন্ত্রী উজির নাজির পাইক পেয়াদা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো রসগোল্লার আবিষ্কারক একজন বাঙালী। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কলকাতার বাগবাজারের চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস রসে ভেজানো গোলাকার রসগোল্লা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। পরে তার পরিচিতি ঘটে রসগোল্লার কলম্বাস। নবীন দাস ছিলেন ময়রা। প্রথমে সন্দেশ বানাতেন। ওই সময়ে বণিক ও বনেদি পরিবার সন্দেশের বিকল্প খুঁজছিলেন। একদিন নবীন দাসের দোকানের সামনে এক্কাগাড়িতে চেপে কলকাতার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি আসেন। জল পান করতে চাইলে এক গ্লাস জলের সঙ্গে একটি রসগোল্লা দেন। যারপরনাই খুশি হয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি দুই হাড়ি রসগোল্লা কিনে নিয়ে যান। ওইদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। স্বজন ও অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এই রসগোল্লা দিয়ে। রসগোল্লা ঠাঁই পেল বৈশাখী উৎসবে। তারপর সকল আনন্দে। এরপর রসগোল্লাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। যে রসগোল্লা নিয়ে এত মাতামাতি তার অন্যতম উপাদান ছানা। প্রাচীন আমলে দুধের ছানা ছিল পরিত্যাজ্য। ফেলে দেয়া হতো। বৈদিক যুগে দুধ থেকে তৈরি খাবার ছিল পৌরণিক ধারার অংশ। বাঙালী এই ছানা থেকে একের পর এক দুগ্ধজাতীয় খাবার বানাতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর হাটের দুগ্ধজাত মিষ্টির খ্যাতি ছিল। আজও আছে। সেই মিষ্টি এখন দেশজুড়ে। ঢাকায় দেড়শ’ বছরের (চার প্রজন্ম) মিষ্টি ব্যবসায়ী মরণচাঁদের। মরণচাঁদের রসগোল্লার সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পৌঁছেছে। বাঙালীর মিষ্টি প্রেমের কথা ফুরোবে না। জীবনের সকল আনন্দ শেয়ার করার আপ্যায়নে মিষ্টি আপনগতিতে চলে আসে। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গেলে মিষ্টি নেয়া হয়। উৎসবে পার্বণে আনন্দে মিষ্টি মুখ না করালে বাঙালীর আতিথ্যের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। মিষ্টির খ্যাতিও আছে অঞ্চল ভেদে। যশোরের জামতলার রসগোল্লা, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা ও ক্ষীরতকতি, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, কুমিল্লার রসমালাই, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, নওগাঁর প্যারার সন্দেশ, রাজশাহীর রসকদম, ফরিদপুরের মালাইসর, খুলনার মিহিদানা লাড্ডু, বরিশালের গটিয়া সন্দেশ ও আদি রসগোল্লা, দিনাজপুরের গুড় ক্ষীরমোহন, রংপুরের হাবসি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কালো তিলকদম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী, পাবনার ইলিশপেটি ইত্যাদি। বৈশাখের আনন্দে গ্রামে নকুলদানা, লই, কদমার পাশাপাশি রসগোল্লা আসন করে নিয়েছে। নগরীর বৈশাখী উৎসবে পান্তা ইলিশ তো আছেই বাদ যায়নি মিষ্টি। বগুড়ার বড় মিষ্টি দোকানি এশিয়ার অন্যতম স্বত্বাধিকারী নুরুল আলম টুটুল জানালেন, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অর্ডার দেয়া শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত যত অর্ডার পেয়েছেন বৃহস্পতিবারের পর আর অর্ডার নেয়া যাবে না। বৈশাখে রসগোল্লার কদর বেশি। তবে অন্যান্য মিষ্টিও বিক্রি হয়।
×