ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় সমঝোতা স্মারক সই

তিস্তা সমস্যার যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের প্রতিশ্রুতি নয়াদিল্লীর

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১০ এপ্রিল ২০১৮

তিস্তা সমস্যার যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের প্রতিশ্রুতি নয়াদিল্লীর

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান ও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের অবস্থানে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। ভারত যত দ্রুত সম্ভব তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া দুদেশের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সড়ক অবকাঠামো এবং যোগাযোগ সংক্রান্ত ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলের এক বৈঠক শেষে দুদেশের মধ্যে এসব সমঝোতা স্মারক সই হয়। সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। বৈঠক শেষে দুদেশের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এছাড়া রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বক্তব্য রাখেন। সোমবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন বিজয় কেশব গোখলে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা এবং দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে ঝুলে থাকা তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিসহ দ্বিপক্ষীয় সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৈঠকের ফল নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। বৈঠকে পর এক যৌথ বিবৃতিতে শহীদুল হক বলেন, ভারত যত দ্রুত সম্ভব এ সমস্যার (তিস্তা চুক্তি) সমাধানে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে, এতে আমি খুবই খুশি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তাদের যে অবস্থান, বিশেষ করে তারা যে এই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়, তাতে আমরা খুবই খুশি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং তিস্তা চুক্তির অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে বলেন, এ সমস্যাটির সমাধানে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি। ভারতকে বাংলাদেশের ‘বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী’ হিসেবে উল্লেখ করে বিজয় গোখলে বলেন, গত সাত বছরে বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, ফলে এই ঋণ খুবই কার্যকর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ যে শুধু ভারতের ঘনিষ্ঠই নয়, বরং দুই দেশের পথচলা একসঙ্গেই- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গোখলে বলেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য দ্বিতীয় ধাপে মানবিক সহায়তা পাঠানোরও ঘোষণা দেন। এর আওতায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার বিভিন্ন সরঞ্জামের সঙ্গে গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্য, শুকনো মাছ, রান্নার চুলা ও জ্বালানি, রেইনকোট এবং গামবুটও থাকবে বলে জানান তিনি। ভারত এর আগে গত সেপ্টেম্বরে তিন লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিল। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ যেভাবে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে বলেও জানান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। তিনি জানান, বাস্তুচ্যুত লোকজনকে দ্রুত তাদের দেশে ফেরাতে এবং এই সঙ্কট সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনেও ভারত উন্নয়ন কর্মকা- চালাচ্ছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ থেকে যারা ফেরত যাবে তাদের জন্য রাখাইনে ঘরবাড়ি নির্মাণে কাজ করছে ভারত। দুদেশের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মরকগুলোর বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, সড়ক অবকাঠামোসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নয়নে আমাদের অংশগ্রহণ প্রচেষ্টার অংশ এটি। এজন্য আমরা এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা দিচ্ছি। বিজয় কেশব গোখলে বলেন, দুই দেশ সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ভারত দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। এ সময় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে শুভেচ্ছা জানান গোখলে। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে বিজয় গোখলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ৬ সমঝোতা স্মারক সই ॥ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সড়ক অবকাঠামো এবং যোগাযোগ সংক্রান্ত ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নুমালিগড় এবং পার্বতীপুরের মধ্যে মত্রী পাইপলাইন স্থাপন, প্রসার ভারতী এবং বাংলাদেশ বেতারের মধ্যে সহযোগিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-আইসিসিআর উর্দু বিভাগে রবীন্দ্র চেয়ার প্রতিষ্ঠা এবং জিসিএনইপি-বিএইসির মধ্যকার চুক্তির বর্ধিতকরণের সমঝোতা। এছাড়া দুটি অনুদান প্রকল্পের জন্যও সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের ৫০৯টি স্কুলে ভাষা গবেষণাগার স্থাপন করবে ভারত। অন্য প্রকল্পটি হল রংপুর শহরের কয়েকটি সড়ক উন্নয়ন। ঢাকা-দিল্লী সোনালি যুগ ॥ ঢাকা দিল্লীর সম্পর্কে এখন সোনালি যুগ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে। তিনি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক শুধু দুদেশের সরকার নয়, মানুষে মানুষে গড়ে উঠেছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি বা সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে দুদেশ সমানভাবে লাভবান। সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইনস্টিটিউট অব পলিসি, এ্যাডভোকেসি এ্যান্ড গবর্নেন্সের (আইপিএজি) উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অমীমাংসিত সব বিষয় ধাপে ধাপে সমাধানের আশা করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটে সহযোগিতা করতে দ্বিতীয় ধাপে ত্রাণ সহায়তা দিতে যাচ্ছে ভারত। উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে উত্তরণকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে বাংলাদেশকে ভারত অন্যতম ইঞ্জিন মনে করে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে যোগাযোগ যেন বাড়ে, সেজন্য ভিসা সহজীকরণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় ১৪ লাখ বাংলাদেশীকে ভিসা দিয়েছে ভারত। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহাসিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে। দুদেশের প্রায় সব বিষয় সমাধান হয়ে গেছে। এখন শুধু এগিয়ে চলা। আমাদের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে আরও বিস্তার করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। সেমিনারে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে এবারই প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। এ সফর এমন সময় ঘটছে যখন গত কয়েক বছরে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা ঝালাই করার সঙ্গে সঙ্গে আগামীর চলার পথের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে রবিবার বিকেলে তিনদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। গত ২৯ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমবারের মতো তিনি ঢাকায় এলেন। আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা ছাড়বেন তিনি।
×