ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাস্তার ধারে অযত্নে ফোটা ফুল বেহুলার পদচিহ্ন

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১ এপ্রিল ২০১৮

রাস্তার ধারে অযত্নে ফোটা ফুল বেহুলার পদচিহ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ ভাঁট ফুলে কী আছে কে বলবে! সাজান বাগানে নয়, রাস্তার ধারে অযত্নে অবহেলায় ফোটা ফুল। পথিকের পা ছুঁয়ে থাকে। এর পরও শুভ্র সাদা ফুলের দিকে তাকালে মন ভাল হয়ে যায়। পবিত্র একটা অনুভূতি হয়। গ্রামের যারা, ফুলটি অনেক দেখেছেন। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই বিলীন হচ্ছে এর প্রজাতি। এখন বেশ দুর্লভ, গ্রামে কমেছে, শহরে আরও বেশি অনুপস্থিত। কিন্তু ফুলপ্রেমীরা খুঁজলে নিরাশ হবেন না। এই চৈত্রে চোখ খোলা রাখলে, মন থেকে খুঁজলে সন্ধান মিলবে ভাঁটের। এই যেমন, গত কয়েকদিন আগে রাজধানী শহর ঢাকার বসিলা এলাকায় ফুলটি দেখার সৌভাগ্য হলো। মোহাম্মদপুরের দিকে আসার পথে একটি সেতু। সেতু থেকে নামতেই দৃশ্যমান হলো প্রিয় ভাঁট। অজ¯্র ফুল ফুটে আছে। ঘ্রাণটাও মিষ্টি খুব। দেখে এত ভাল লাগে যে, লিখে প্রকাশ করা মুশকিল। হ্যাঁ, ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে এখনও আছে ভাঁট। একসঙ্গে অনেক ফুল ফুটে আছে। এখন মৌসুম। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার শ্রেষ্ঠ সময়। ভাঁট ফুল ভাঁটি নামেও পরিচিত। নিজের বিভিন্ন লেখায় কবিগুরু ফুলটিকে ‘ভাঁটি’ নামে সম্বোধন করেছেন। কোন এক প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, আশপাশে ভাঁটিফুল ফুটিয়া/ রয়েছে দলে দলে...। ভাঁটফুলের আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ শিরোনামে লেখা গল্পটিতে পাওয়া যায় এই ঘণ্টাকর্ণকে। গল্পের একটি চরিত্র ঘণ্টাকর্ণ। এর দুই কানে দুই ঘণ্টা। লেজও দুটি। দুই লেজে দুই হাতুড়ি। ওগুলো দিয়ে নিজেই নিজের ঘণ্টা বাজিয়ে যায়! আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন- বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়...। হ্যাঁ, বেহুলার পায়ের ঘুঙুরকে তিনি ভাঁট ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রিয়তম পতি লক্ষ্মীন্দরকে সাপে কাটার পর সতী স্ত্রী বেহুলা তাকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করেন। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নেতাই ধোপানির সঙ্গে যান স্বর্গলোকেও। ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে রাজসভায় নাচতে হয় তাকে। রূপসী বাংলার কবি সেই নৃত্যরত বেহুলাকে কল্পনার চোখে দেখেছিলেন। পায়ে পরিয়ে দিয়েছিলেন ভাঁটফুলের ঘুঙুর। ফুলটি তাই বেহুলার পদচিহ্নও বটে। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফুটে আছে ভাঁট। বিশেষ করে গ্রামে খুব দেখা যাচ্ছে। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ রাস্তার ধারে, জঙ্গল বা বনের আশপাশে এলাকায় ফুটে আছে। কারও যত্নের দরকার হয় না। কেউ তেমন ঘরে তুলে নেন না। তাতে কী? নিজ উদ্যোগে বেঁচে থাকে গাছ। এর গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। ছোট সাদা পাঁচটি পাপড়ি। চারটির মতো সাদা লম্বা কেশর। ফুলের মাঝখানে হলুদের ওপর হাল্কা মেরুন রংয়ের ছোঁয়া। কেশরের অগ্রভাগে আবার বেগুনি রংয়ের রেণু। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, ভাঁটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ক্ল্যারোডেনড্রাম ভিসকোসাম ভেন্ট। এর পাতা চার ইঞ্চি থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিম্বাকৃতি পাতার আগা সরু খসখসে। বোঁটা ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। মঞ্জরিদ- ১২ ইঞ্চির মতো। গাছ মাটি থেকে খুব উপরে ওঠে না। এর কচি কা- গায়ে নরম রোম হয়। ফুলের বাইরের আবরণেও রোম থাকে। ভাঁটফুলের আছে ঔষধি গুণ। সেই গুণের কথা বেশ মজা করে লিখেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। লেখাটি এ রকম- ঘণ্টাকর্ণের বিয়ে হয়েছিল বসন্ত-বিষফোঁড়া রোগের দেবী শীতলার সঙ্গে। এই ঘণ্টাকর্ণ, ঘেঁটু বা ভাঁটে জ্বর চর্মরোগ বিছের হুল ফোটানোতে ওষুধের কাজ করে। আর কী আশ্চর্য বসন্তকালে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এমনকী ম্যালেরিয়া জ্বরে, পা-ু রোগে, অজীর্ণে এর রস কাজ করে ওষুধের মতো। এ জন্য চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘণ্টাকর্ণ বৃক্ষের আরাধনা করা হয় চর্মরোগ নিবারণের জন্য। তিনি জানাচ্ছেন, এখনও গ্রামের মানুষ জ্বর হলে এর পাতার রস খেয়ে থাকে। ক্রিমি, পুরনো শূল বেদনা দূর করতে ভাঁট একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ। বৈদ্যদের পাশাপাশি ইউনানি হেকিমেরাও এর ব্যবহার করেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। সে যাই হোক, ফুলটি আরও কিছুদিন তাজা থাকবে। আগে যারা দেখেছেন, আবার দেখুন। যারা দেখেননি তাদের না দেখলেই নয়। দেখুন খুঁজে নিন।
×