ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

লঘুপাপের শাস্তি ‘বাধ্যতামূলক বই পড়া’

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ মার্চ ২০১৮

লঘুপাপের  শাস্তি ‘বাধ্যতামূলক বই পড়া’

আজাদ সুলায়মান ॥ অবসরে বই পড়া কারো কাছে বিনোদন, কারো কাছে নেশা। আবার ‘শাস্তি’ হিসেবে কখনও কখনও বই পড়তে বাধ্য করা হতো- শৈশবের এমন নজিরও রয়েছে অনেকের। শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করার দায়ে একেক জন একেক ধরনের শাস্তি দেন। কেউ কানমলা দেন, কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেন, কেউ বা এক ঘণ্টা বই পড়তে কিংবা কবিতা মুখস্থ করতে বাধ্য করেন। শাস্তির এমন সনাতনী ধারাই এবার চালু করেছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। বিমানবন্দরে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া নানা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়তই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টকে সমাধান দিতে হচ্ছে। দায়িত্ব পালনের সময়ে চুপিসারে ঘুষ খাওয়া, লাগেজ কাটা ও যাত্রী হয়রানির মতো ছোটখাটো অপরাধের বিচার প্রতিনিয়তই করতে হচ্ছে এই মোবাইল কোর্টকে। এতে শাহজালালের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকাটই নিয়ন্ত্রণে। গত তিন বছর ধরে ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ বনসুরি এ ধরনের দেনদরবার ও বিচার আচার করে বেশ আলোচিত। তিনিই উদ্ভাবন করলেন এই অভিনব পদ্ধতি। তিনি গত তিন বছরে অন্তত কয়েক হাজার অভিযোগের নিষ্পত্তি ঘটিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে ছোট অপরাধের দরুন লঘু শাস্তির মতোও পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে অনেককে। যেমন একবার নিরাপত্তা কর্মীকে সামান্য কটা টাকা ঘুষসহ হাতে-নাতে ধরে তিনি কোন শাস্তি না দিয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করেন। এতে তাৎক্ষণিক তার চাকরি চলে যায়। যা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের কাছে লঘু পাপে গুরু দ- বলে বিবেচিত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবার ইউসুফ চালু করলেন নতুন এই পদ্ধতি। ছোট খাটো অপরাধ করলেই বই পড়ার শাস্তি অনিবার্য। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হিসেবে বই পড়া কার্যক্রম শুরু করেছে ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়। বৃহস্পতিবার থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শাস্তির এই অভিনব পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ। শাস্তির এহেন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, অন্ধকার দূর করতে আলোর বিকল্প নাই। তাই এ ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। কেউ টুকিটাকি অপরাধে ধরা পড়লে তাকে বই পড়তে বাধ্য করা হবে। আর যারা পড়তে পারে না তাদের পড়তে শিখতে হবে। শাস্তির কবলে পড়া অপরাধীকে এক সপ্তাহ পর বই জমা দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে পড়া শেষ করে সেই বই ফেরত দেয়া যাবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিই বইটির মালিক হবে এবং যতœ করে সেই বই বাসায় রেখে দেবে। ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাসায় বই দেখে হয়ত ভবিষ্যতে কখনও পড়তে আগ্রহী হবে। কিন্তু অফেরতযোগ্য হওয়ায় লাইব্রেরিতে বইয়ের ঘাটতি হবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি নতুন বই কিনে লাইব্রেরিতে জমা দেবে- বলেন ইউসুফ। বই পড়ার মাধ্যমে দ- প্রদানের বিষয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে লেখা হয়েছে- ‘নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। সবার মতামতের ভিত্তিতে সংযোজন-বিয়োজনের প্রত্যাশায় শেয়ার করছি। এয়ারপোর্টে তিন, চার শিফটে ব্যাপক সংখ্যক জনবল কাজ করে। বড়বড় হয়রানি বা ক্রাইমের পাশাপাশি কিছু টুকিটাকি লেভেলের হয়রানিও প্রতিনিয়ত হয়। যেমন- ট্রলির বিনিময়ে ৫০/১০০ টাকা গ্রহণ, এ জাতীয় মেলা টুকিটাকি। প্রথম প্রথম এই টুকিটাকিদের আর্থিক জরিমানা করতাম। কিন্তু এতে তাদের চাকরি চলে যেত। ফলে দুই ধরনের সমস্যা ফেস করতে হয়, ১) লঘু পাপে গুরু দ- হয়ে যায় এবং ২) নতুন যারা নিয়োগ পায়, তারা আবার নতুন উদ্যোমে শিক্ষানবিশের ভূমিকায় হয়রানি শুরু করে। বরং পুরাতনদের রেখে কারেকশন করে নেয়াটা উত্তম মনে হতো। তাই ভবিষ্যতে আর করবে না মর্মে লিখিত রেখে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু সেটাও আবার একেবারে শাস্তিহীন হয়ে পড়ায় খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। যারা এখনও ধরা পড়ে নাই, তারা নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রথম হলুদ কার্ড না খাওয়া পর্যন্ত ঠেলে খেলে গোল দেয়ার রিস্ক সব প্লেয়ারই নিয়ে থাকে। সুতরাং উপায়? কারেকশনের জন্য জ্ঞানের চেয়ে শক্তিশালী কিছু হতে পারে না। অন্ধকার দূর করতে আলোর বিকল্প নাই। টুকিটাকিতে ধরা পড়লেই হাতে একটা বই ধরিয়ে দেয়া হবে। এক সপ্তাহ পর বই জমা দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এটা তাদের দৃষ্টিতে শাস্তি হতে পারে, আমার দৃষ্টিতে পুরস্কার। অনেকে হয়ত ভাবছেন, আমি কায়দা করে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের বই ধরিয়ে দেব। নাহ, এখানে সব ধরনের বই থাকবে। তবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস তো থাকবেই এবং তা প্রথম সেল্ফের প্রথম সারিতে। অভিযুক্ত স্বাধীনভাবে বুকসেল্ফ ঘাঁটাঘাঁটি করে বই নির্বাচন করবে। এতে বাড়তি পাওনা হিসেবে শুরুতেই তার অনেকগুলো বইয়ের নামের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা খুব একটা কঠিন বইতে যেতে চাচ্ছি না। মজার মজার সহজ উপন্যাসগুলোতে জোর দেব। উদ্দেশ্য, বই পড়ার মজাটা ঢুকিয়ে দেয়া, জাস্ট সেই নেশার বীজটা বপন করে দেয়া। দ্বিতীয়বার ধরা পড়ার পর থেকে সিলেবাস একটু একটু করে কঠিন হবে, বিষয় এবং সারমর্ম প্রাধান্য পেতে থাকবে। একেবারে স্লো পয়জনিং যেটাকে বলে। পড়া শেষ করে সেই বই ফেরত দেয়া যাবে না। অভিযুক্তই বইটির মালিক হয়ে যাবে এবং যতœ করে বাসায় রেখে দেবে। ছেলেমেয়েসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাসায় বই দেখে হয়ত ভবিষ্যতে কখনও পড়তে আগ্রহী হবে। কিন্তু আমার লাইব্রেরিতে অফেরত বইয়ের ঘাটতি কে পূরণ করবে? ভাবছেন, আমি পূরণ করব? ভুল। অভিযুক্তই নতুন একই বই কিনে লাইব্রেরিতে জমা দেবে। লাইব্রেরি থাকবে সব সময় নতুন, ঝকঝকে। আহ, নতুন বইয়ের ঘ্রাণই আলাদা। সেকেন্ড হ্যান্ড বই এই লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ। পড়া শেষে পরীক্ষা পদ্ধতি কি হবে? এক সপ্তাহ পর, উপন্যাসের গল্পটি ছোট করে নিজের মতো করে রচনা আকারে লিখে আনতে হবে এবং গল্পটি সে জানে কি না, তা তাকে মৌখিকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। আপনি বলবেন, সে তো অন্য কাউকে দিয়াও লিখিয়ে এনে ফাঁকিবাজি করতে পারে। আবার মৌখিক পরীক্ষার জন্য ওই তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে উপন্যাসের গল্প শুনে শুনে একটা আইডিয়া নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারে। আজকাল প্রশ্নফাঁস হলে কেন্দ্রের বাইরে পোলাপান যেমনটা করে আর কি! কিন্তু কোন সমস্যা নাই। এই ফাঁকিবাজির কারণে তৃতীয় আরেকজন পাঠক বাড়বে। অন্যদিকে সেই ব্যক্তির মুখে শুনে শুনে প্রস্তুতি নিতে গেলেও কাহিনীর ভেতর দিয়া তাকে যেতে হবে। আমি তো কেবল তাকে সাহিত্যের মজাটা ধরিয়ে দিতে চাই। উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবে আমার সহকারীরা। এজন্য তাদের আগেই রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করে পালাক্রমে লাইব্রেরির আংশিক সিলেবাস কমপ্লিট করিয়ে নেয়া হবে। ধীরে ধীরে সব বই তাদের পড়া হয়ে যাবে। বইয়ের পাশে থেকে বই পড়বে না, তা হবে না। মৌখিক পরীক্ষা নেব আমি এবং আমার কলিগ। আর বুঝতেই পারছেন, না পড়ে কিন্তু আমাদের পরীক্ষক হওয়া যাবে না। কাজেই পাঠক চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ পরীক্ষায় ডাব্বা মারলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? ওয়ান-প্লাস রেফার্ড সিস্টেম ব্যবস্থা থাকবে। কোন কথাবার্তা ছাড়াই আগের বইয়ের সঙ্গে নতুন আরেকটা বই ধরিয়ে দিয়ে আবার এক সপ্তাহ সময় দেয়া হবে। এভাবে তার মাথায় বইয়ের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। একটা গুরত্বপূর্ণ বিষয় বাদ থেকেই যাচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ অনেকের মধ্যে যদি কেউ একেবারেই পড়াশোনা না জানে, কিংবা কেবল স্বাক্ষর সর্বস্ব হয়, তারা পড়বে কিভাবে? উত্তর একেবারেই সহজ। তারা পড়বে না, পড়তে পারা শিখবে। তাদের জন্য ‘বাল্যশিক্ষা’ পর্যায়ের বই-পুস্তক থাকবে।
×