ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

রবি’র বিরুদ্ধে আরও ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রবি’র বিরুদ্ধে আরও ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বেসরকারী মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিরুদ্ধে আরও ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি অভিযোগ তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট ফাঁকির সব টাকা জমা দেয়ার জন্য মঙ্গলবার রবির কাছে ৫টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে এই চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছে। এনবিআরের চিঠি পাওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেছে রবির কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছে, এনবিআর যে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তুলেছে, তা তারা আইনগতভাবে মোকাবেলা করবে। উল্লেখ্য, ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি ছাড়াও এর আগে রবির কাছে কয়েকবার রাজস্ব ফাঁকির দাবিনামা জারি করে এনবিআর। যদিও এনবিআরের সব দাবির বিরুদ্ধে মোবাইল ফোন কোম্পানিটি মামলা করায় রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণের বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া একটি অনলাইনকে বলেছেন, ‘রবি হোক, গ্রামীণফোন হোক, ভ্যাট ফাঁকি দেয়া ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। রবি ছাড়াও গ্রামীণ ফোনসহ যে সব প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি কাস্টমস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান যতœবান হওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমাদের আপীল ট্রাইব্যুনাল ও জোনকে অনিষ্পন্ন মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সব মামলা নিষ্পত্তি হলে সরকার অতিরিক্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা পাবে বলেও জানিয়েছিলেন।’ জানা গেছে, মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন, ভ্যাট রিটার্ন ও ব্যাংক হিসাব যাচাই-বাছাই করে বিপুল ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পায় এনবিআর। রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, রবি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে ৭১১ কোটি ৮২ লাখ ১১ হাজার ৯১৭ টাকা ৪ পয়সা ফাঁকি দিয়েছে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ রেয়াত নিয়েছে ১১৬ কোটি টাকা। এনবিআর বলছে, ইন্টারকানেকশনে প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে রবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘এনবিআর থেকে এ বিষয়ে প্রথম চিঠি পাওয়ার পর এনবিআরের কাছে একটি অডিট রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই অডিট রিপোর্ট দেয়নি। পরে রবির পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়। কিন্তু তারা সময়ও দেয়নি। শুধু তাই নয়, এ ক্ষেত্রে রবির কোনও বক্তব্যই নেয়া হয়নি।’ ওই কর্মকর্তারা জানান, মোবাইল কোম্পানিগুলো নির্ধারিত ফি দিয়ে বিটিসিএল থেকে ইন্টারকানেকশন সেবা নেয়। কিন্তু বিটিসিএল-এর ভ্যাট নিবন্ধন নেই। তারা মূসক চালান দেয় না। এ কারণে এনবিআরকে বলা হয়েছে, ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কিন্তু এনবিআর সেই ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ভ্যাট দাবি করেছে। বিটিআরসি যে সেবা দিচ্ছে, তার ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রযোজ্য নয়। বিটিআরসি মূসক চালান দিলে মোবাইল কোম্পানিগুলো অবশ্যই ভ্যাট দেবে। এনবিআরের নিরীক্ষায় উঠে আসে, প্রতিষ্ঠানটি এসএপি সফট্ওয়্যার খাতে ৫৫৩ কোটি ৬১ লাখ ১২ হাজার ৫২৮ টাকা ২০ পয়সার মূসক ও ১৫৮ কোটি ২০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮৮ টাকা ৮৪ পয়সার উৎসে মূসক কম পরিশোধ করে ফাঁকি দিয়েছে। এনবিআরের আরেক চিঠিতে উল্লেখ আছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিধি বহির্ভূতভাবে ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬২ টাকা ২৫ পয়সা রেয়াত নেয়ার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। অন্য চিঠিতে বলা হয়, মোবাইল অপারেটরটি ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬ হাজার ৩৪৮ টাকা ৬৭ পয়সার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এ ছাড়া, রবি ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একবছরে ইন্টারকানেকশন চার্জের ওপর ১ কোটি ৬৫ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ টাকা ৩ পয়সা মূসক পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, রবি ও এয়ারটেল এর একীভূত করার ক্ষেত্রে চার্জ ফি ১০০ কোটি টাকা এবং এয়ারটেল লিমিটেডের অনুকূলে বরাদ্দকৃত টু-জি স্প্যাক্ট্রাম চার্জের ক্ষেত্রে ২০১১ সর্বশেষ টু-জি লাইন্সেস এর আওতায় তরঙ্গ নবায়ন মূল্যের সমন্বয়ে ৫০৭ কোটি টাকাসহ ৬০৭ কোটি টাকার ওপর মূসক প্রযোজ্য। ১৫ শতাংশ হারে ৯১ কোটি ৫ লাখ টাকা মূসক পরিশোধ করেনি। এ বিষয়ে গত নবেম্বরে রবিকে চিঠি দিয়েছিল এনবিআর। সব মিলিয়ে গত চার বছরে (২০১৩ থেকে ২০১৬) রবি ৯২৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮৫ হাজার ১২৯ টাকা ৯৯ পয়সা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এর বাইরে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর আরও প্রায় ৮ কোটি টাকার ভ্যাট (মূসক) ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে এ মূসক ফাঁকি দিয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর এলটিইউ-মূল্য সংযোজন কর শাখা পাওনা আদায়ে রবিকে চিঠি দেয়। এরও আগে রবি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ জুন পর্যন্ত স্থান ও স্থাপনা ভাড়া হিসেবে ১৫ কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এ ছাড়া সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৪১৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ফাঁকি খুঁজে পায় এনবিআর। এ টাকা পরিশোধ না করে আদালতে যায় রবি। এর আগেও রিপ্লেসমেন্টের নামে পুরনো সিম বিক্রির মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ ওঠে রবির বিরুদ্ধে। এনবিআরের দাবি অনুযায়ী রিপ্লেসমেন্টের নামে রবি ২৮৫ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার ৫৩৫ টাকা ৭ পয়সা এবং রবির সঙ্গে একীভূত হওয়া এয়ারটেলও ৫০ কোটি ২৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩২২ টাকা ৫৯ পয়সা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর বাইরে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় অনিষ্পন্ন ১৭ মামলায় ঝুলে আছে ১ হাজার ৪২৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার পাওনার বিষয়টি।
×