ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

অস্কারে মনোনয়ন না পাওয়ায় খুশি!

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অস্কারে মনোনয়ন না পাওয়ায় খুশি!

অস্কার পুরস্কার এখনও অনেকের অধরা। ফলে মনোনয়ন পেলেই বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ভাসার কথা তাদের। কিন্তু নিজের দেশের ছবি ‘ফক্সট্রট’ মনোনীত না হওয়ায় উল্টো খুশি ইসরাইলের সংস্কৃতিমন্ত্রী মিরি রিজেভ! বলা যায় তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। গত ২৩ জানুয়ারি অস্কারের মনোনয়ন তালিকা ঘোষণার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন এই ডানপন্থী নারী রাজনীতিবিদ। স্যামুয়েল মাওজ পরিচালিত ইসরাইলী ড্রামা চলচ্চিত্র ‘ফক্সট্রট’। সিনেমাটি এরই মধ্যে সিনেমা বোদ্ধাদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়েছে। সিনেমাটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিয়েছে গ্র্যান্ড জুরি এ্যাওয়ার্ড। ভেনিস রিভিউ সিনেমাটিকে ইসরাইলী সামরিক জীবনের শোক আর নিষ্পেষণের প্রতি এক তীব্র উপহাস বলে মূল্যায়ন করেছে। ফক্সট্রটের শুরুর দৃশ্য দেখে অনেকের মনে হতে পারে এটা পরিচালকের গোল্ডেন লায়নজয়ী সিনেমা লেবাননের (২০০৯) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পূরক কাহিনী। লেবানন ছিল এক তরুণ ইসরাইলী সেনা হিসেবে নিজের মনের মধ্যে থাকা বেদনা, ক্ষতের সরল প্রকাশ; যুদ্ধের ত্রাসকে উপস্থাপন করা। লেবানন সিনেমাটি তৈরি হয়েছে একটি ট্যাঙ্কের ভেতরে, ট্যাঙ্কের লেন্স দিয়ে দেখানো হয়েছে যুদ্ধের ত্রাস। ফক্সট্রটও শুরু হয়েছে আবদ্ধ অনুভূতির নাটক দিয়ে। সিনেমার শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়, মধ্যবয়সী স্বামী-স্ত্রী ডাফনা ও মিশায়েল তাদের বাসায় অনাকাক্সিক্ষত অতিথিদের গ্রহণ করছেন। এই অতিথিরা ইসরাইলী সেনা, তারা এসেছেন ডাফনা ও মিসাইল দম্পতির তরুণ পুত্র, ইসরাইলী সেনা জোনাথন ফেল্ডম্যানের মুত্যু সংবাদ নিয়ে। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লেন, জ্ঞান হারিয়ে দরজাতেই লুটিয়ে পড়েন। জোনাথনের বাবার মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। একটু পরে তিনি ইসরাইলী সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সময়মতো পানি পানের জন্য একটা টেক্সট পান। যদিও তিনি তৃষ্ণার্ত কিনা, সেটা কর্তৃপক্ষ মাথায় নিতে চায়নি। একটু পরেই সেনারা আবার ফিরে এলো। তারা এবার জানাল, তারা ভুল করেছে যে জোনাথন মারা গেছে, সে তাদের ছেলে নয়, অন্য জোনাথন। এবার মিশায়েল আগের চেয়েও ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, ‘আমার ছেলে ৫ ঘণ্টা আগে মারা গেছে।’ দর্শকরা খুব কাছ থেকে দেখতে পাবেন কীভাবে ডাফনা ও মিশায়েল দম্পতির জীবন ভেঙ্গে পড়ল। এটা পরিষ্কার মানবজীবনের বেদনা প্রকাশেই উচ্চকিত হয়েছেন স্যামুয়েল মাওজ। সঙ্গে এটাও নিশ্চিত, তিনি একই সঙ্গে তার দেখানোর পরিধিটা বিস্তৃত করতে চেয়েছেন। সিনেমার এই শুরুর দৃশ্যে তিনি ভাবলেশহীন কিছু কৌতুককেও প্রবিষ্ট করিয়েছেন। মিশায়েলকে সান্ত¦না দেয়ার সময় সেনারা অদ্ভুতভাবে নিয়মিত পানি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছিল। তারা মিশায়েলের ফোনে পানি খাওয়ার জন্য প্রতি ঘণ্টায় সঙ্কেত দেবে এমনটা একটি ব্যবস্থা চালু করে দেয়। সিনেমার দ্বিতীয় অংশে দর্শকরা দেখতে পাবেন ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে একটি পথ অবরোধ। আগের ক্লোজআপ শট থেকে দর্শক এবার নীল আকাশের নিচে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখতে পাবেন। চারজন সেনা পথের অবরোধটি পাহারা দিচ্ছে আর এই চারজনের একজনের নাম জোনাথন ফেল্ডম্যান। দেখা যায়, জোনাথন তার বন্দুকটিকে সঙ্গীর মতো ধরে ফক্সট্রট নাচ নাচছে। বিরাট বিস্তৃত নীল আকাশের তলায় তাকে খুব ছোট দেখাচ্ছে। পরিচালক এখানে নিশ্চিতভাবেই আধুনিক সামরিক জীবনের বিষণœতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইসরাইলের সব তরুণ-তরুণীকেই বাধ্যতামূলকভাবে কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হয়। তবে দর্শকদের মনে সন্দেহ কিন্তু নিরসন হবে না, এই জোনাথন কি ডাফনা ও মিশায়েল দম্পতির তনুণ পুত্র নাকি অন্য কোন জোনাথন, যে ¯্রফে কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে? মাওজ কিন্তু দর্শকদের সন্দেহ দূর করতে খুব একটা সহায়তা করেননি। দর্শক বরং একজন সৈনিককে বলতে শুনবেন, ‘এখানে যা দেখছেন, তা সবই এক বিভ্রম।’ সিনেমার শেষে দর্শকরা আবার মিলিত হবেন ডাফনা ও মিশায়েল দম্পতির সঙ্গে। দর্শকরা দেখবেন ভাগ্য এই দম্পতিকে আরও একটি আঘাত দিয়েছে। শুরুতে এই পারিবারিক বেদনায় ফিরে আসা নিয়ে দর্শক বিভ্রান্ত হতে পারেন। জোনাথনের বিদায়ের শোক পরিণত হলে বোঝা যাবে মাওজ তার ঝুলিতে একটি কূটকৌশল তখনও লুকিয়ে রেখেছেন। মাওজের বার্তাটি পরিষ্কারÑ দুনিয়া তার ভারসাম্য হারিয়েছে আর প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ৯০তম এাকাডেমি এ্যাওয়ার্ডসের সেরা বিদেশী ভাষার ছবির বিভাগে ইসরাইলী থেকে জমা পড়ে ‘ফক্সট্রট’। তবে ওই মন্ত্রীর মন্তব্য, এটি ইসরাইলবিরোধী ছবি। তাই এটি অস্কার মনোনয়ন না পাওয়া তিনি উচ্ছ্বসিত! অস্কারের ভোটারদের প্রশংসা করে আর্মি রেডিওকে মিরি রিজেভ বলেন, ‘অস্কারে মনোনয়ন না পাওয়ায় আমরা বেঁচে গেছি! এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হতো। তিক্ত হতাশা থেকে পরিত্রাণ পেলাম। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের ফিল্ম এ্যান্ড টেলিভিশন এ্যাকাডেমি ছবিটিকে পুরস্কৃত করায় সমালোচনা শোনা গেছে এই মন্ত্রীর কণ্ঠে। কারণ এতে তার অসম্মতি ছিল। তাই ওই এ্যাকাডেমিতে সরকারের আর্থিক সহায়তা বাতিলের হুমকিও দেন তিনি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গ্র্যান্ড জুরি প্রাইজ সিলভার লায়ন পুরস্কার জেতে ‘ফক্সট্রট’। এই স্বীকৃতি গ্রহণের পর পরিচালক স্যামুয়েল মাওজ বলেন, ‘আমি যেখানে থাকি সেই জায়গার সমালোচনা করেছি, কারণ আমি চিন্তিত। এ অবস্থার পরিবর্তন চাই আমি। দেশের প্রতি ভালবাসা থেকেই কাজটা করেছি।’
×