ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত হওয়ায় ;###;পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

প্রধান সড়কে নেই যানজট-মানবজট

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রধান সড়কে নেই যানজট-মানবজট

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ নারায়ণগঞ্জ নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত হওয়ায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। বঙ্গবন্ধু সড়কে আগের মতো নেই যানজট। এ সড়কের ফুটপাথে নেই মানবজট। নির্বিঘ্ন এ সড়কের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে নগরবাসী। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছে নগরীর মানুষ। গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে নগরীতে শুরু হয় হকার উচ্ছেদ অভিযান। অনেকেই বলছেন, বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ হওয়ায় নাখোশ হয়েছেন সুবিধাভোগীরা। কারণ সুবিধাভোগীরা লাখ লাখ টাকার চাঁদার ভাগ পেতেন। নগরীবাসীর এখন একটাই দাবি অন্তত বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথটি হকারমুক্ত রাখতেই হবে। তারা যেন আর এ সড়কের ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করতে না পারেন। এক মাসের অধিক সময় ধরে নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ দিয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাচ্ছেন নগরবাসী। এতে নগরবাসী সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণঞ্জ। অথচ নারায়ণগঞ্জের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নগরীর যানজট। নারায়ণগঞ্জ নগরী ছাড়াও বন্দরবাসী শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ নগরী দিয়ে ট্রেন অথবা অন্য কোন গণপরিবহনে করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকেন। আবার মুন্সীগঞ্জ জেলার বহু লোকজন নদীপথে লঞ্চ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছেন। এছাড়াও নগরীর লঞ্চ টার্মিনাল দিয়ে শরীয়তপুর ও চাঁদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন উপজেলার বহু লোকজনও এই নগরীর অতিক্রম করে ঢাকায় যাতায়াত করছেন। ট্রাফিক পুলিশরা নগরীর যানজটের জন্য ফুটপাথ দখলকেই বরাবর দায়ী করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে নগরবাসীর দাবি ছিল নগরীর যানজট নিরসন করা। ফুটপাথ থেকে হকারমুক্ত করা। সেই দাবির প্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় নগরীর ফুটপাথ থেকে হকারমুক্ত করার অভিযান। এরপর হকাররা আবারও সড়কগুলোর ফুটপাথে বসে ব্যবসা করার জন্য আন্দোলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী চালিয়ে আসছিল। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী ফুটপাথে হকার না বসার পক্ষেই অনড় থাকেন। কিন্তু স্থানীয় শামীম ওসমান হকারদের সমর্থক দেন। ফলে গত ১৬ জানুয়ারি ফুটপাথে হকার বসানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকদের সঙ্গে সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানে সমর্থক ও হকারদের ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এ সংঘর্ষে মেয়র আইভী, সাংবাদিক ও পুলিশসহ কমপক্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এ নিয়ে পুরো নারায়ণগঞ্জ নগরী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি অভিযোগ দেয়া হয়। পুলিশ বাদী হয়ে এক হাজার লোকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। খবর নিয়ে জানায়, সংঘর্ষের ঘটনার দু’দিন পরে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধু সড়ক ছাড়া অন্য সড়কগুলো বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত হকার বসতে পারবে। এরপর থেকে হকাররা বঙ্গবন্ধু সড়কটি হকারমুক্ত রয়েছে। অবশ্য পুলিশ জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু সড়কটি হকারমুক্ত রাখা হবে। এ সড়কে আর হকার বসতে দেয়া হবে। এতেও নগরবাসী কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রকাশ করছেন। বঙ্গবন্ধু সড়কটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ নগরীর প্রধান একটি সড়ক। ট্রাফিক পুলিশের টিআই (সদর) একেএম শরফুদ্দিন জানান, মূলত গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে নগরীর ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। অভিযানে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের ফুটপাথ থেকে হকারমুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সড়ক, শায়েস্তা খাঁ সড়ক, সিরাজ-উদ-দৌলা সড়ক, মীর জুমলা সড়ক, বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল সড়কসহ ১নং ও ২নং রেলগেট, ডিআইটি, কালিরবাজার ও চাষাঢ়াসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হকারমুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু গত ১৮ জানুয়ারি সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধু সড়ক ছাড়া অন্যান্য সড়কের ফুটপাথে হকার বিকেলে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসতে পারবেন। এখন বঙ্গবন্ধু সড়কটি ২৪ ঘণ্টাই হকারমুক্ত থাকছে। বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ দিয়ে পথচারীরা নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারছে। তিনি দাবি করেন ২৬ ডিসেম্বরের পর থেকে নগরীতে বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়নি। নগরীর গলাচিপার বাসিন্দা ছালামত উল্ল্যাহ জানান, হকারদের যন্ত্রণায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ গিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম না। সড়কের ফুটপাথ দখল করে পসরা সাজিয়ে দোকানপাট নিয়ে বসার কারণে যানজট সৃষ্টি করা হতো। এখন এ সড়কের ফুটপাথ থেকে হকারমুক্ত হওয়ায় এ সড়কটি একেবারেই ফাঁকা। তবে এখনও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যার পরে হকাররা হাতে করে কিংবা ক্ষুদ্র পরিসনে দোকান নিয়ে বসছে। আবার পুলিশ দেখলেই তারা আড়ালে চলে যাচ্ছে। এটাও নিরসন হওয়াও দরকার। নগরীর দেওভোগ নাগবাড়ির বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে এজন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে ধন্যবাদ জানাই। নগরবাসী প্রতিটি সড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত দেখতে চায়। বঙ্গবন্ধু সড়কটি এখনও ফাঁকা (হকারমুক্ত থাকায়) এ সড়ক দিয়ে স্বাচ্ছন্দে হেঁটে যাওয়া যায়। কতিপয় কিছু লোকের জন্য পুরো নারায়ণগঞ্জবাসী কষ্ট করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, মেয়র আইভীর পিতা আলী আহম্মেদ চুনকার আমল থেকেই কয়েকবার হকারদের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হকাররা সেই সুযোগটি নেননি। হকারদের দোকানপাট দেয়া হয়েছিল। সেই দোকানপাট তারা বিক্রি করে আবারও তারা রাস্তায় বসেছে। কলেজ ছাত্রী নাবিলা আক্তার ও মৌসুমী আক্তার জানান, যদিও বঙ্গবন্ধু সড়ক ফুটপাথে প্রায় সময় কিছু কেনাকাটাও করতাম। তবুও বঙ্গবন্ধু সড়কটি ফুটপাথ হকারমুক্ত হওয়ায় আমরা নির্বিঘ্নে হেঁটে যেতে পারছি। কারণ জরুরী সময়ে এ সড়ক দিয়ে হকারদের কারণে ফুটপাথ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাওয়া যেতো না, মানবজটে পড়তে হতো। এ সড়কে হকারমুক্ত হওয়ায় মানবজটে পড়ে হয় না। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক বলেন, প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশনকে মিলে হকার উচ্ছেদের জন্য আমরা মেয়রসহ বিভিন্ন দফতরে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছিলাম। অবশেষে প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন একত্রে কাজ করে হকার উচ্ছেদ করেছে। বঙ্গবন্ধু সড়কটি এখনও হকারমুক্ত রয়েছে এজন্য আমরা খুশি। নাগরিক কমিটি ও পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা সিটি কর্পোরেশন ও প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধু সড়কে বিক্ষিপ্তভাবে দুই চারটি হকার বসছে। এটাকে সুযোগ দেয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া হলে আবারো তারা আস্তে আস্তে এ সড়কে পসরা সাজিয়ে বসে পড়বে। তিনি আরও বলেন, আমরা পত্রিকায় দেখলাম নারায়ণগঞ্জ শহরে নাকি চার হাজার হকার রয়েছে। হকার এতো বেশি না। আমরা জানি পূর্বে সাড়ে ৬শ’ হকারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। তারা ওই ওসব দোকানপাট বিক্রি করে আবার তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। এটা নিন্দনীয় কাজ। আমরা বলতে চাই যারা প্রকৃত হকার, তাদের প্রকৃত হকার লিস্টে নাম ছিল তাদের মধ্যে যারা এখনও দোকানপাট বরাদ্দ পায়নি তাদের জন্য একটি ব্যবস্থা করা মানবিক দায়িত্ব। নগরীর জিমখানা উন্মুক্ত মঞ্চে জনতার মুখোমুখি অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, চার হাজার হকারের জন্য নগরীর পাঁচ লাখ মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। ফুটপাথ দিয়ে নগরবাসী চলাচল করবে। সিটি কর্পোরেশনের সার্ভে অনুযায়ী হকার সংখ্যা মাত্র ৬শ’। কিন্ত হকারদের দাবি চার হাজার। আমি হকারের পেটে লাথি মারি নাই। বাংলাদেশে আমিই প্রথম হকারদের পুনর্বাসনের জন্য হকার্স মাকের্ট নির্মাণ করে দিয়েছে। হকাররা সেই দোকান ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দামে বিক্রি করে দিয়ে আবারও তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগের টিআই (প্রশাসন) মোল্লা তাসলিম হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে সারা শহরে কোন যানজট নেই। বঙ্গবন্ধু সড়কে যানবাহন পার্কিং করায় সে সকল যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রং পার্কিংয়ের জন্য ওই সকল গাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিদিনই মামলা ও রেকারিং করা হচ্ছে। তা অব্যাহত থাকবে। নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) মোঃ শরফুদ্দীন বলেন, বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ হওয়ায় এ সড়কটি এখন সম্পূর্ণরূপে ফাঁকা রয়েছে। মানুষের চলাচলে সুবিধা হচ্ছে। মানুষজন চলাচলে শান্তি পাচ্ছে। সর্বস্তরের মানুষই পুলিশের কার্যক্রমের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধু সড়কের আর ফুটপাথে হকার বসতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু সড়ক ব্যতীত অন্যান্য সড়কে হকাররা বসে ব্যবসা করছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) আব্দুস রশিদ জানান, আমরা আশা করব বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখার অবস্থাটি সকলের সহায়তায় ধরে রাখব। হকাররা ফুটপাথে বসে, ভ্যান নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়। মানুষজন কেনাকাটা করে। রিক্সাসহ যানবাহন থামায়। এতে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় মানুষজন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে না পেরে রাস্তা দিয়ে হাঁটে। এতেই সৃষ্টি হয় যানজট। এদিকে নগরীর অনেকেরই অভিমত, সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন কতদিন সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখতে পারবেন একটাই এখন দেখার বিষয়।
×