ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ শুক্রবার বাণিজ্যমেলা;###;যেন জনসমুদ্র

নানা অফার, ছাড়- একটা কিনলে তিনটা ফ্রি

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নানা অফার, ছাড়- একটা কিনলে তিনটা ফ্রি

ওয়াজেদ হীরা ॥ ব্যবসায়ীদের আবেদন আর দর্শনার্থীর আগ্রহ দুইয়ে মিলে বাড়ানো বাণিজ্যমেলার চার দিন সময়ও শেষেরদিকে। বাণিজ্যমেলার সময় বাড়ানো হলেও মূল আকর্ষণ ছিল ছুটির দিন শুক্রবার। বিনোদনহীন নগরীতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে বইপ্রেমী মানুষের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। তাই ইচ্ছা থাকলেও বাণিজ্যমেলায় আসেনি বইপ্রেমী একশ্রেণীর দর্শনার্থী। তাতে মেলায় দর্শনার্থী কম, বিষয়টা তাও নয়। বরং মেলার সময় বাড়ানোর কারণে যারা ‘মিস’ করেছেন তাদের পাশাপাশি শেষবারের মতো মেলায় ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা সেরেছেন দর্শনার্থীরা। মানুষের ভিড়ে এবারের শেষ শুক্রবার জনাকীর্ণ মেলায় শুধুই মানুষ। ডানে-বামে, সামনে কিংবা পেছনে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ যোগ দিল বিদায়ী বাণিজ্যমেলায়। শুক্রবার ছিল ছুটির দিন। মানুষের ভিড়ও ছিল বেশ। সকাল থেকেই মানুষের আগমন শুরু হয়। তবে অন্যান্য সকালের মতো টিকেট কাউন্টারে ভিড় লেগে যায়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বেড়েছে। আর কাউন্টারে ভিড় দেখা গেছে দুপুরের পর থেকেই। এদিকে এদিন সন্তানদের নিয়ে সকালের দিকে অনেকেই ছুটে গেছেন বইমেলায়। তবে দুপুরের পরে বইমেলা ঘুরে অনেকেই বাণিজ্যমেলা হয়েই বাসায় ফিরেছেন। মেলার শেষ শুক্রবার বলে কথা। শুধু শেষ শুক্রবারই নয় আজ বাদে আগামীকাল মেলারই ইতি টানা হচ্ছে। ফলে শেষ সময়ের কেনাকাটা আর যারা এখনও আসেনি মেলায় তারাও পেলেন মেলা দেখার সুযোগ। শুধু কেনাকাটাই নয় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিনোদনেরও অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলা মাঠের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান মীর ব্রাদার্সের মালিক মীর শহিদুল আলম জানিয়েছেন, দর্শনার্থী মোটামুটি আসছে। তবে আগের শুক্রবারের তুলনায় দর্শনার্থী অনেক কম। মেলায় গিয়ে দেখা যায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ মেলায় আসছে। বন্ধুদের সঙ্গেও মেলায় এসেছেন কেউ কেউ। জানতে চাইলে ইব্রাহিম হোসেন ও তার বন্ধুরা জানান, মেলায় কিছু কিনতে নয় শুধুই ছুটির দিনে একটু ঘুরতে এসেছেন। দুপুরের পর থেকে মেলামুখী মানুষের যাত্রা দেখলে যে কারও মনে হতে পারে এ যেন হাজারো মানুষের ছুটেচলা মিছিল, যাচ্ছে কোন জনসভায়! সব পথই যেন মিশে গেছে মেলা প্রাঙ্গণে এসে। সন্ধ্যায় মেলায় বাইরে শুধুই মানুষ আর মানুষ। এ যেন মানুষের জনসমুদ্র! মানুষের চাপে আশপাশের রাস্তায় বেশ জটলা বেঁধে যায়। মেলার বিভিন্ন টিকেট কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে সকাল থেকেই মানুষের টিকেট বিক্রি খুবই বেশি। মেলার দুপাশের শ্যামলী-নিউমার্কেট সড়ক এবং মিরপুর ১০-ফার্মগেট সড়কে প্রচুর যানযটেরও সৃষ্টি হয়। দর্শনার্থীদের কয়েক কি.মি. হেঁটেও মেলায় আসতে হয়েছে। মেলা শেষে যানবাহন না পেয়েও বেশ ভোগান্তি হয়েছে দর্শনার্থীদের। এদিকে, কেউ কেউ ঘুরতে এলেও কেউ অবশ্য কিনেছেনও। মেলায় নানা পণ্যে নানা রকম ছাড় দেখে কেউ না কিনে পারেনি। বিভিন্ন পণ্যে দশ থেকে শুরু করে ষাট শতাংশ বা কোন কোন স্টলে আরও বেশি ছাড় দিচ্ছে। মেলায় বিভিন্ন স্টলে গিয়ে দেখা যায় একটি পণ্য কিনলে তিনটি ফ্রি দেয়া হচ্ছে। আর শেষ সময়ের কেনাকাটায় মানুষ ফ্রিতে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন পণ্যের ফ্রি ও ছাড় দেয়া প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, মেলার সময় শেষ পণ্য ফেরত না নিয়ে বিক্রি করতে পারলেই ভাল। এজন্য মূলত ছাড় দেয়া হচ্ছে। এদিকে, মেলায় শেষ সময়ে হকারদের আগমনটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলার ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা এ সকল হকারকে মেলায় বসতে দিয়েছে। একাধিক হকারের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, যে ব্যক্তি মেলায় বসতে দিয়েছে তাতে প্রতিদিন দোকান হিসাবে টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় হকারদের। ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাম নিয়ে তাদের অভিযোগ নেই। পণ্য পছন্দ হলেই কিনছেন তারা। আর ক্রেতা আকৃষ্ট করতে মিষ্টি কথার পাশাপাশি কেউ দিচ্ছেন মূল্যছাড়সহ নানা অফার। থাকছে গ্যারান্টিসহ বিক্রয়োত্তর নানা সেবার নিশ্চয়তা। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরাবরের মতো এবারও মেলায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে গৃহস্থালি পণ্যের। পুরোদমে কেনাকাটা শুরু না করলেও ক্রেতা বেছে বেছে গৃহস্থালি পণ্যের স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরছেন। পছন্দ হলে কেউ কেউ কিনছেন। যথারীতি, মেয়েদের পণ্য বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানে উপচেপড়া ভিড়। জুয়েলারি ও সাজসজ্জার বিভিন্ন স্টলে বিক্রয়কর্মী ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আপন ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী বলেন, মেলার শেষ সময় আবার দুই সেট জামার সঙ্গে একটা ফ্রি। ক্রেতা সামলানো মুশকিল। বিক্রিও হচ্ছে হরদম, বলেন বিক্রয়কর্মী। হাজারো মানুষের পদচারণা যেখানে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নারী ও শিশুদের তুলনামূলক কষ্ট একটু বেশিই হয়। অনেক শিশু হারানোর বিজ্ঞপ্তি শোনা যায় মেলা প্রচার কেন্দ্র থেকে। বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও মানুষের ভিড়ে নিজেদের বাচ্চাদের হারিয়ে ফেলছিলেন মা-বাবারা। কেউ হারিয়ে যাওয়ার খবরের পাশাপাশি কাউকে পাওয়ার খবরও জানিয়ে দেয়া হচ্ছিল প্রচার কেন্দ্র থেকে। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মেলায় এসেছেন জসিম উদ্দিন। মানুষের চাপে বেশ বিরক্ত তিনি। তবে সন্তানদের উচ্ছ্বাসে বিরক্তকে চেপে রাখার চেষ্টাও করেন। বিরক্তের কারণটা স্পষ্ট। এত মানুষের ভিড়ে শুধু হাঁটতেই কষ্ট নয় ধুলাবালিতে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বসে বিশ্রাম নেয়ারও জায়গা পাচ্ছে না। ছুটির দিনে অধিকাংশ দর্শনার্থীর অবস্থা একই। দুপরের দিকে মেলার চারপাশ ধুলায় একাকার। গাড়ি আর মানুষের হেঁটে চলার মিছিলে সবাইকে নাক-মুখ চেপে হাঁটতে দেখা গেছে। বেসরকারী চাকরিজীবী বুলবুল খালেদ বলেন, শত কষ্ট হলেও ছুটির দিনই তো ভরসা। মেলার সময়ও শেষ। তাই কষ্ট হলেও একটু বিনোদন তো পেলাম, বলেন তিনি। এদিন, ক্রোকারিজ ও প্লাস্টিকের পণ্যের স্টল ও প্যাভিলিয়নেও ভিড় ছিল নারীদের। বিভিন্ন বিস্কুট, নুডুলস, জুস তাদের একাধিক পণ্য একত্রিত করে ছাড়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। মেলায় একটু কমে কিনতে পেরে একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পণ্য হওয়ার কারণে আকৃষ্ট হয় ক্রেতারা। এদিকে, শীতের প্রকোপ কিছুটা কমে আসায় ব্লেজারের স্টলগুলোতে তেমন একটা ভিড় নেই। এদিকে, তরুণীরা ছুটেছেন সাজসজ্জা জুয়েলারি কিনতে। প্রতিটি স্টলে কমপক্ষে অসংখ্য বিক্রয়কর্মী থাকা সত্ত্বেও ক্রেতা সামলাতে পারেনি তারা। এছাড়াও তরুণীরা জুতার স্টলগুলোতেও ছুটেছেন পছন্দসই জুতা কিনতে। বাচ্চাদের জন্য তাদের মা-বাবা ছুটেছেন খেলনার স্টলে। মেলায় কেনাকাটার পাশাপাশি বিনোদনেও অংশ নিয়েছেন দর্শনার্থীরা। মেলায় অবস্থিত মিনিপার্কে শিশুরা বিভিন্ন রাইডে উঠে আনন্দ পায়। সন্তানের আনন্দে উৎফুল্ল বাবা-মাও। এছাড়াও মিনি সুন্দরবনের পাশে গিয়ে সুন্দরবন কেমন সে ধারণাও দেন অভিভাবকরা। এছাড়া যারা এখনও সুন্দরবন দেখেনি তারাও একটা ধারণা নিয়ে নেন। হাজারো মানুষের পথচলার ভিড়ে হকারদের উৎপাতে বেশ অতিষ্ট ছিল দর্শনার্থী। বিভিন্ন খেলনা, শাল, স্কার্ফ, জুতা, বাচ্চাদের আকৃষ্ট করার পণ্য হকারদের বিক্রি করতে দেখা গেছে। এমনকি বিভিন্ন খাবারও বিক্রি করছেন হকাররা। ১০০টি সিসিটিভির মাধ্যমে পুরো মেলা তদারকি করা হয়। নিরাপত্তার জন্য র‌্যাব-পুলিশ-আনসার তো আছেই। তবুও এদিন পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়েছে দর্শনার্থী সামলাতে। বিভিন্ন অভিযোগ ও তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য মেলায় প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োজিত আছেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সঙ্গে পরিচিত করতে বাংলাদেশ ছাড়াও বাণিজ্যমেলায় ১৭টি দেশ অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ শনিবারও ভিড় থাকবে দর্শনার্থীর আর আগামীকাল রবিবার তো মেলার ইতিই টানা হবে।
×